বিভূতিভূষণ যে মানবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা সারল্যে অসাধারণ। সনাতন গ্রামবাংলার জনজীবনের চিরায়ত ছবি তিনি এঁকেছেন নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায়। গভীর মমতায়, শ্রমে তিনি এই কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে আশ্চর্যরকম সফল তিনি। গ্রামীণ জীবনের শান্ত, সরল, স্নিগ্ধ ও বিশ্বস্ত ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নিরাসক্ত কথকতা ও বয়ানে, চুম্বকের মতো টেনে নেয় পাঠককে। মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে।
প্রবন্ধ -- বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ -- অমর কথাশিল্পীর জন্মদিনে
কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ - ১লা নভেম্বর, ১৯৫০)
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার কাঁচরাপাড়ার নিকটবর্তী ঘোষপাড়া-সুরারিপুর গ্রামে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস একই জেলার বারাকপুর গ্রামে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়্ এবং মাতা মৃণালিনী দেবী। তাঁর পিতা ছিলেন সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত। সংস্কৃতে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য পিতৃদেব 'শাস্ত্রী' উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। পিতামাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে বিভূতিভূষণ ছিলেন সবার বড়।
বাল্যকালে পিতার নিকট বিভূতিভূষণের হাতেখড়ি। এরপর গ্রামীন পাঠশালার পাঠ চুকিয়ে ইংরাজী মাধ্যম বনগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি। মেধাবী ছাত্র বিধায় সেখানে অবৈতনিক শিক্ষার্থী হিসেবে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে পিতৃবিয়োগ। ১৯১৪তে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স এবং ১৯১৬তে কলকাতাস্থ রিপন কলেজ (সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ১৯১৮তে একই কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় ডিস্টিংশনসহ পাশ। এরপর তিনি এমএ ও আইন বিষয়ে ভর্তি হন। কিন্তু পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে হুগলী জেলার জাঙ্গীপাড়ায় দ্বারকানাথ হাইস্কুলে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করেন। এরপর যোগ দেন গোপালনগর স্কুলে। এই স্কুলেই তিনি আমৃত্যু কর্মরত ছিলেন। এই মহান কথাসাহিত্যিক ১৯৫০ খ্রীস্টাব্দের ১লা নভেম্বর বর্তমানে ঝাড়খণ্ডের ঘাটশিলায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাল্যকালেই তথা তৃতীয় শ্রেণীতে অ্যধ্যয়নকালে বসিরহাটের মোক্তার কালীভূষণ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা গৌরী দেবীর সাথে বিবাহ। কিন্তু বিয়ের এক বছর পরই গৌরী দেবীর মৃত্যু। স্ত্রী শোকে মুহ্যমান হয়ে কিছুদিন তিনি সন্ন্যাসব্রত অবলম্বন করেন। পরে ১৯৪০-এর ৩রা ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার ছয়গাঁও নিবাসী ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে রমা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। একমাত্র সন্তানের নাম তারাদাস বন্দোপাধ্যায় বাবলু।
মূলত উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে তিনি খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেন। পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী ও অশনি সংকেত তাঁর অমর সৃষ্টি। উপন্যাস ছাড়াও তিনি ২০টি গল্পগ্রন্থ, অনেকগুলো কিশোর উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনীও রচনা করেন। বিভূতিভূষণের "পথের পাঁচালী" উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় সৃষ্টি করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র। "ইছামতী" উপন্যাসের জন্য ১৯৫১তে তিনি রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন
গ্রামীণ জীবনের অসামান্য রূপকার, নিম্নবর্গের কথাশিল্পী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। আদি প্রাণের আধুনিক বন্দনাকার বিভূতিভূষণ নাকি নিসর্গ চেতনার বাতিঘর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়- এরকম নানাভাবে, বিভিন্ন অভিধায় তাকে অভিহিত করা যায়, যেতে পারে। মানুষের এই মহান কথাকার ,‘ তুচ্ছের মধ্যে অমৃতের সন্ধান করে গেছেন বিভূতিভূষণ। কীভাবে তা মিলতে পারে অমৃতের স্বাদ নিতে নিতেই আমাদের তা জানিয়ে গেছেন। আমাদের নিজেদের অমৃত মিলুক আর না মিলুক, তাঁর লেখা পড়েই বুঝতে পারা যায় সমস্ত জীবনে তাঁর এ বস্তুর গরমিল হয়নি।
সাহিত্য সমালোচকগণ বলছেন, বিভূতিভূষণ যে মানবজগৎ সৃষ্টি করেছিলেন তা সারল্যে অসাধারণ। সনাতন গ্রামবাংলার জনজীবনের চিরায়ত ছবি তিনি এঁকেছেন নিপুণ, দক্ষ শিল্পকুশলতায়। গভীর মমতায়, শ্রমে তিনি এই কীর্তি স্থাপন করে গেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে আশ্চর্যরকম সফল তিনি। গ্রামীণ জীবনের শান্ত, সরল, স্নিগ্ধ ও বিশ্বস্ত ছবি ফুটে ওঠে তাঁর নিরাসক্ত কথকতা ও বয়ানে, চুম্বকের মতো টেনে নেয় পাঠককে। মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। অথচ পথের পাঁচালী, অপরাজিত, আরণ্যক, ইছামতির মতো অসামান্য সব উপন্যাসের রচয়িতা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখালেখির জীবন ছিল স্বল্প। মাত্র আঠাশ বছর। এই লেখকের আয়ু ছিল মাত্র ৫৬ বছর। তাঁর রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে ১৫টি উপন্যাস, সাতখানা কিশোর উপন্যাস, দুইশ’র বেশি ছোটগল্প। পনেরোটি উপন্যাসের মধ্যে একটি ছিল অসমাপ্ত। শিশু-কিশোর উপন্যাসের মধ্যে তিনটি হলো বয়স্কপাঠ্য উপন্যাসের কিশোর সংস্করণ। এসবের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও তিনি লিখে গেছেন। সেগুলোর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণকাহিনী, ডায়েরি, প্রবন্ধ, অনুবাদ। ব্যাকরণ বইও তিনি লিখেছেন। উপন্যাস ও ছোটগল্প, ভ্রমণ-দিনলিপি এবং কিশোরদের উপযোগী রচনা-গদ্য সাহিত্যে এ চারটি কীর্তিস্তম্ভের ওপর বিভূতিভূষণের সাহিত্যিক কৃতিত্ব। এ চারটি কিন্তু একে অপরের থেকে কোনো অর্থেই ভিন্ন নয়। সুরে, বিষয়-নির্বাচনে, প্রশান্ত চিত্তের সহৃদয়তায় এগুলো যেমন সরস তেমনি জীবনরসে পূর্ণ। বিভূতিভূষণের অস্তিত্ব জুড়ে আমৃত্যু-প্রথম আবির্ভাবের পর থেকে শ্রীমান অপু বিরাজিত। তার বিস্ময়ভরা দৃষ্টি দিয়ে বিভূতিভূষণ চারপাশের মানুষকে, প্রকৃতিকে দেখছেন এবং আনন্দিত হয়েছেন। সুখে দুঃখে তার সমান আনন্দ, কারণ বালকের মন সহজে দুঃখের স্মৃতি ভুলে যায়। অভাব-অভিযোগের মধ্যেও একটা সুখের কল্পরাজ্য তৈরি করে নেয়। আবার, বিভূতিভূষণের শিল্পী ব্যক্তিত্বের পরিচয় নিতে গেলে আরো একটি দিকে লক্ষ্য না করে পারা যায় না। একদিকে একান্ত লৌকিক জীবন অতিসাধারণ ও প্রাত্যহিক, পরিচিত প্রকৃতি, বাস্তব অরণ্য-যার ভূগোল আছে, অন্যদিকে আছে অলৌকিক, অতি প্রাকৃতের প্রতি আকর্ষণ। তিনি একালের শিল্পী হয়েও ধর্মে আস্থাবান ছিলেন এবং পরলোক, জ্যোতিষবিদ্যা, মৃত্যুর পরবর্তী অস্তিত্ব এবং অন্যান্য বিবিধ অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করতেন। এর কারণ হিসেবে তার জীবনী থেকে জানা যায়, যখন ছাত্র ছিলেন, তখন তেইশ বছর বয়সে বিয়ে করেন। বিয়ের বছরখানেক বাদে স্ত্রী গৌরী মারা গেলেন নিউমোনিয়ায়। এর কিছুদিনের মধ্যেই ছোট বোন মণির মৃত্যু ঘটে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে। এই দু’টি মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি মারাত্মক আঘাত পেলেন মনে। ধারণা করা হয়, তাঁর পরলোকে বিশ্বাস, পরলোকতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা এবং চর্চার কারণ ওই দু’টি বিয়োগান্তক ঘটনা। প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যুর দীর্ঘ ২২ বছর পরে আবার বিয়ে করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইংরেজ শাসনের ফলে এবং নবজাগরণের পরবর্তীকালে বাংলাদেশে যে সাহিত্যের জন্ম, রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যার বিস্তার। তাকে বাংলা সাহিত্যের ‘স্বর্ণযুগ’ বলা যাক বা না যাক, মার্কসীয় পদ্ধতিতে তার বিচার করতে গেলে আমাদের মনে রাখতে হবে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী সাহিত্যবিচারের মূল সূত্র : সাহিত্য হচ্ছে সামাজিক বাস্তবের প্রতিফলন, সমাজের স্তরে স্তরে শ্রেণী সংঘর্ষের প্রভাবে নিত্য যে আলোড়ন চলছে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে তাতে সাড়া দেয়। এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে নির্বাচিত হয় সমাজের বিন্যাস কীভাবে পরিবর্তিত হয়, এ সমাজের গতি যাবে কোন দিকে। সাহিত্য এই শ্রেণীচেতনা হতে সৃষ্ট হয়ে সামাজিক পরিবেশের ওপর প্রতিঘাত করে। ‘লেখকমাত্রই মেধাবী’ কথাটি নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে সাহিত্য বোদ্ধামহলে। তবে একজন লেখক যে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন হবেন তা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। একজন বড় সাহিত্যিকের ‘টোটাল’ পরিচয় নিহিত থাকে তার সাহিত্যকর্মের ব্যাপ্তি ও বহুমুখীনতায়। বহুবিধ সংযোগ ও লিখন প্রতিভার গুণে একজন সৎ সাহিত্যিক নিজের জন্য পাঠক-বোদ্ধামহলে স্থায়ী আসন করে নিতে সম। এ ক্ষেত্রে লেখক তার চারিত অভিজ্ঞানের বিস্তৃতি ঘটান তার সৃষ্টিকর্মে। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবেশ, প্রতিবেশ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি স্তরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলী তাকে পরিমার্জিত শৈলীতে উপস্থাপন করতে হয় তার সাহিত্যে। যাপনের এমন কোনো বিষয়-আশয় নেই যা একজন সাহিত্যিক স্পর্শ করতে অম। যে কারণে সৎ সাহিত্যিকের হাতে রচিত সাহিত্যকর্ম যুগ যুগ ধরে পাঠক তার অন্তঃস্থলে ধরে রাখে। অনেক সময় দেখা যায়, আপাতসরল দৃষ্টিতে সমাজ সম্পর্কে উদাসীন সাহিত্যিকের রচনাতেও গভীরভাবে উঠে আসে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার অনুপুঙ্খ বাস্তবতা। এক্ষেত্রে সাহিত্যিক অনেকটা অজ্ঞাতসারেই তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সম হন। এরূপ রচনা পাঠে আলোচকরা প্রথমদিকে রচনাটির শিল্পমূল্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও সেটির নিবিড় পাঠ ও পর্যালোচনায় আবিস্কৃত হয় অপরিমেয় শিল্পমূল্য এবং সমাজ মূল্য। এ ধরণের সাহিত্য পাঠে সাহিত্যিকের এক ধরণের নিরীক্ষাপ্রবণ মানসিকতার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে। উন্মেষ ঘটে লেখকের শ্রেণীসচেতনতার। লিখনীতে মানব-সংসারের বিচিত্রতা তেমনভাবে ফুটে ওঠেনি এমন অভিঘাতে জর্জরিত হতে হয় ‘পথের পাঁচালী’র অমর রূপকার বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাহলে প্রশ্ন জাগে- বিভূতিভূষণ কি শ্রেণীচেতন ছিলেন না? মানুষের জীবন-যাপনের প্রতিমুহূর্তের বিবর্তিত অবস্থা, সংঘাত জানতেন না তিনি? প্রকৃতার্থে বিভূতিভূষণ রচিত উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের চরিত্র স্থান, কাল, পাত্র সমন্বয়িত হতে দেখা যায় সুষম বিন্যাসে। উপন্যাসিক হিসাবে বিভূতিভূষণের খ্যাতি বেশি হলেও তার গল্পগুলোতে আবেগঘন পরিস্থিতির প্রাধান্য থাকায় সমকালীন অনেক সমালোচক তার ব্যাপারে ঔদাসীন্য দেখিয়েছেন। তার ‘মেঘ মল্লার’ (১৯৩১), ‘মৌরীফুল’ (১৯৩২), ‘জন্ম ও মৃত্যু’ (১৯৩৮), ‘নবাগত’ (১৯৪৪) গ্রন্থের গল্পগুলো শ্রেণীচেতন বিভায় সমুজ্বল। বিভূতিভূষণের রচনাতে একদিকে যেমন ফুটে ওঠে শ্রেণী-বৈষম্য তেমনি রয়েছে নর-নারীর শ্বাশত রোমান্টিকতা। রয়েছে প্রকৃতি অবলোকনের অপূর্ব দর্শন। ইউরোপ-আমেরিকার নবজীবন-চেতনার প্রবাহ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের প্রবল হাওয়ায় তৎকালীন ভারতের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক জীবনের আলোড়ন, আক্ষেপ, হতাশা নানামুখী বৈশিষ্ট্য নিয়ে তার রচনাশৈলীতে স্পষ্টভাবেই মুদ্রিত।
বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের পর বাংলা উপন্যাসের প্রবহমান ধারায় তিনি যুক্ত হন বিশ শতকের তিনের দশক শুরুর প্রাকলগ্নে। 'পথের পাঁচালী' (১৯২৯) নিয়ে উপন্যাসের ভুবনে তার প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর তাকে আর ফিরে ডাকাতে হয়নি। বাংলা শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর তালিকায় স্থান করে নেয় 'পথের পাঁচালী'। এরপর তিনি রচনা করেন আরো ১৩টি উপন্যাস। ফলে তার মোট উপন্যাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪টিতে। এগুলো হলো- 'অপরাজিত' (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৩২),' দৃষ্টিপ্রদীপ' (১৯৩৫), 'আরণ্যক' (১৯৩৯), 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৯৪০), 'বিপিনের সংসার' (১৯৪১), 'দুই বাড়ি' (১৯৪১), 'অনুবর্তন' (১৯৪২), 'দেবযান' (১৯৪৪), 'কেদার রাজা' (১৯৪৫), 'অথৈ জল' (১৯৪৭), 'ইছামতী' (১৯৫০), 'দম্পতি' (১৯৫২) ও 'অশনি সঙ্কেত' (১৯৫৯)। তার সমকালে আর দুজন দাপুটে ঔপন্যাসিক ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে, ১৯০৮-৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৬) ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (২৪ জুলাই, ১৮৯৮-১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)।কিন্তু নিভৃতচারী এই কথাশিল্পীই রচনায় পল্লীর জীবন ও নিসর্গ রূপায়ণে বাংলার আবহমানকালের চালচিত্র ও মানবজীবনের অন্তর্লীন সত্তা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচনায় প্রকৃতি কেবল প্রকৃতিরূপেই আবির্ভূত হয়নি, বরং প্রকৃতি ও মানবজীবন একীভূত হয়ে অভিনব রসমূর্তি ধারণ করেছে। মানুষ যে প্রকৃতিরই সন্তান এ সত্য তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির লতাপাতা, ঘাস, পোকামাকড় সবকিছুই গুরুত্বের সঙ্গে স্বস্বভাবে তাঁর রচনায় স্থান পেয়েছে। প্রকৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ গভীর জীবনদৃষ্টিকেও তুলে ধরেছেন। তবে তাঁর রচনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালির জীনবচিত্র ও সমকালের আর্থসামাজিক বাস্তবতাও সমভাবে উন্মোচিত হয়েছে। তাই বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্রের পরে বিভূতিভূষণই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাহিত্যিকের মর্যাদা পেয়েছেন।
বিভূতিভূষণ প্রায় অধিকাংশ রচনাতেই প্রকৃতিকে মানব জীবনের সাথে একত্র, সম্পৃক্ত করে দেখিয়েছেন। কখনো বা এই প্রকৃতিকে আধ্যাত্মনুভূতির আধার রূপে চিত্রিত করেছেন। মানুষ–প্রকৃতি–ঈশ্বর তিনে মিলে বিভূতিভূষণের সাহিত্যলোক গড়ে উঠেছে। কল্লোল যুগের স্বভাবসিদ্ধ রক্তমাংস প্রাণের ত্রিধাতু মিশ্রিত শারীর শবাসনে না বসেও তিনি তাঁর সৃষ্টিতে যেন সুদূর স্বর্গলোকের অমৃতগন্ধ বয়ে এনেছেন। প্রকৃতি সম্পর্কে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি তার একান্ত নিজস্ব মৌলিকতা। বিভূতিভূষণের কাছে কোনো নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধের কোনো বিচ্ছিন্ন অর্থ ছিল না, যদি না সেসব নীতি, তত্ত্ব বা মূল্যবোধ মানুষকে আশ্রয় দিতে না পারে। সুতরাং এ কথা বলা মোটেও অসঙ্গত নয় যে, গ্রামীণ জীবনের নীতিবোধ ও মূল্যবোধের রক্ষণশীলতা বিভূতভূষণ সমর্থন করেননি। তিনি শ্রেণী বিদ্বেষীও নন কিংবা ব্যক্তিগতভাবেও কাউকে ঘৃণার চোখে দেখেননি। যে কারণে তার অধিকাংশ ছোটগল্পই গ্রামীণ জীবনের শান্তি ও পারস্পরিক নিশ্চিন্ততা নিয়ে বেড়ে ওঠে। তিনি নিজে বলেছেন, ‘সাহিত্য আমাদের কল্পনা ও অনুভব-বৃত্তিকে উজ্জীবিত করে।... কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী যত কথা বলেন, তার মর্ম এই যে আমাদের ধরণী ভারী সুন্দর- একে বিচিত্র বললেই বা এর কতটুকু বোঝান হলো! আমাদের এ দৃষ্টিটি বারে বারে ঝাপসা হয়ে আসে, প্রকৃতির বাইরেকার কাঠামোটাকে দেখে আমরা বারে বারে তাকে ‘রিয়ালিটি’ বলে ভুল করি, জীবন-নদীতে অন্ধ গতানুগতিকতার শেওলাদাম জমে, তখন আর স্রোত চলে না; তাই তো কবিকে, রসস্রষ্টাকে আমাদের বারবার দরকার- শুকনো মিথ্যা-বাস্তবের পাঁক থেকে আমাদের উদ্ধার করতে।’
নিম্নবর্গের মানুষের জীবনের সাথে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িত আছে প্রকৃতি।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকৃতির রূপকার, আর এই প্রকৃতিকে আশ্রয় করে তার আড়ালে তিনি আমাদের শোনান নিম্নবর্গের মানুষের জীবনকথা, তাঁর সাহিত্যের একটা বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে অবহেলিত, নির্যাতিত মানুষের জীবনভাষ্য; তিনি চেয়েছিলেন যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের সুখ-দুঃখকে সাহিত্যে রূপায়ণ করতে, তাই তাঁর সাহিত্য ক্যানভাসে সাধারণ মানুষের, নিম্নবর্গের মানুষের ভিড়/ মিছিল লক্ষণীয়; যে মানুষগুলো সমাজের প্রান্তে বাস করার সঙ্গে সঙ্গে এমন এক পেশাকে অবলম্বন করে জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যা পায় না সমাজে উচ্চ মর্যাদা বা স্বীকৃতি, তাই তাদের পেশা হয়ে থাকে ভিক্ষুক, ফকির, ফেরিওয়ালা, জুয়া খেলুড়ে, বাড়ির পাচক, দরিদ্র স্কুল শিক্ষক, মুহুরি, ওষুধ বিক্রেতা, টিউবওয়েলের ব্যবসাদার, মুচি, পটল ব্যবসায়ী, ঘুণ ব্যবসাদার, কুলিগিরি, স্টেশনের সিগন্যাল ক্লার্ক, পতিতা প্রভৃতি। আর এসব পেশাকে অবলম্বন করে বিভূতিভূষণের গল্পের নিম্নবর্গরা পোকামাকড়ের মতো জীবনকে টেনে এগোতে থাকে সামনের দিকে, পার করতে থাকে দিনগুলো। আর তাদের অর্থনীতি ভীষণ ভঙ্গুর ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর’ মতো, একটা জোটে তো আরেকটা জোটে না, দারিদ্র্য নির্মাণ করে চারপাশের পরিবেশ।
চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এটির চলচ্চিত্রায়ন করেন। ফলে এই উপন্যাসের খ্যাতির পরিধি বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়ে। বিভূতিভূষণ সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করেন এই উপন্যাসটির মধ্য দিয়েই। এটিই তাঁর প্রথম উপন্যাস, একই সঙ্গে প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থও। পথের পাঁচালী প্রথমে ধারাবাহিকভাবে বের হয়েছিল মাসিকপত্র ‘বিচিত্রা’য়। এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছিল এতে। বই আকারে এটি বের হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। এ বই বেরুবার আগে সাময়িকপত্রে এই লেখকের কয়েকটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। লেখক হিসেবে সামান্য পরিচিতি ছিল তখন। সেই সময় এ বিশাল আয়তন উপন্যাসের প্রকাশক জোগাড় করার কাজটি সহজ ছিল না। ঝুঁকি নিয়ে এ দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। তার নিজস্ব কোনো প্রকাশনা সংস্থা ছিল না। শুধু এ বইটা বের করার জন্যই তিনি ‘রঞ্জন প্রকাশালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ‘পথের পাঁচালী’ বই হিসেবে বেরুবার আগেই বিচিত্রা পত্রিকায় এর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হতে থাকে। সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়, বইটির দাম রাখা হবে তিন টাকা। বিজ্ঞাপন ছিল এরকম : “শ্রীবিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত বাঙলা ভাষায় সম্পূর্ণ নূতন ধরনের উপন্যাস। শিশুমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্য ইতিপূর্বে আর কেহ এদেশে এরূপভাবে উদ্ঘাটিত করেন নাই; অন্য দেশেও কেহ করিয়াছেন কি না আমাদের জানা নাই। উপন্যাসখানি ‘বিচিত্রা’য় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হইতেছে। ইতিমধ্যেই সাহিত্য-রসিক মহলে ইহার সম্বন্ধে বিস্তর আলোচনা হইয়াছে।”রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, ‘বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে।’
আরণ্যক উপন্যাসটি সম্পূর্ণ নতুন প্রকৃতির। প্রকৃতি এখানে মুখ্য, মানুষ গৌণ। সত্যচরনের দেখা এই প্রকৃতি কখনও পরি রাজ্যের মায়াময়, অপার্থিব স্বপ্ন সৌন্দর্য, কখনও প্রেতলোকের বিভীষিকায় আচ্ছন্ন। এই উপন্যাসটিতে লেখকের Cosmic Imagination স্ফূরিত হয়েছে। আদিম অরণ্য জাতির সংস্পর্শ একদিকে যেমন বন্য মহিষের রক্ষাকর্তা, ট্যাঁড়বারো দেবের কল্পনাকে রূপ দিয়েছেন, অন্যদিকে তেমনই যুগ-যুগান্ত প্রসারিত তাঁর ঐতিহাসিক কল্পনাকে প্রবুদ্ধ করেছে। আসলে এসবের পিছনে আছে বিভূতিভূষণের শিল্পী মন-
“দিকচক্রবালে দীর্ঘ নীল রেখার মত পরিধির সমান এই পাহাড় ও বন দুপুরে, বিকালে, সন্ধ্যায় কত স্বপ্ন আনে মনে।”
আরণ্যকের প্রাণ অরণ্য। তাই অরণ্যের মানুষ ভানুমতী ও দোবরুপান্না যেন অরণ্যের সৌন্দর্য ও মর্যাদার প্রতীক।
তিনি প্রকৃতির প্রেম, প্রকৃতির নিজস্বতা, প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ককে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। আসলে শিল্পের রস শিল্পেই থাকে। তাকে গ্রহণ করতে হয় শৈল্পিকভাবে।
বিভূতিভূষণের শেষ জীবনে রচিত দুটি উপন্যাস হল-‘ইছামতী’ (১৯৫০), ‘অশনি সংকেত’ (মৃত্যুর পর প্রকাশিত, ১৯৫৯)। প্রকৃতি প্রেম, জীবনের প্রতি অনুরাগ আর সেই সঙ্গে গভীর ঈশ্বরপ্রেম তিনে মিলে সৃষ্টি হয়েছে ‘ইছামতী’। উপন্যাসের নায়ক পরিব্রাজক ভবানী বাঁড়ুয্যে গৃহী হয়েছে। কিন্তু তার অন্তরে যে অধ্যাত্মপিপাসা তা নষ্ট হয়নি। আসলে বিভূতিভূষণ এক অধ্যাত্মবিশ্বাসী, আদর্শবাদী শিল্পী। যিনি প্রকৃতি মুগ্ধতায় এবং গ্রাম জীবন ও পূর্বতন পারিবারিক জীবনের সারল্যে বিশ্বাস করেন। ‘ইছামতী’ সে বিশ্বাসের ছবি। ‘অশনি সংকেত’ তাঁর সমৃদ্ধ উপন্যাস নয়। এখানে মৃত্যুর বার্তা শুনতে পেয়েছেন লেখক।
We hate spam as much as you do