গত মোটামুটি কম সংক্রমণের পাঁচ মাস (অক্টোবর '20 থেকে ফেব্রুয়ারি'21) হাসপাতাল , অক্সিজেন, এবং অন্যান্য মেডিকাল সাপোর্ট ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরির ব্যবস্থার জন্য ব্যবহার করা যেত ! আমাদের দেশের প্রায় ৫০টা কোম্পানি ভ্যাকসিন বানাতে পারে। ঠিকমত পরিকল্পনা এবং সরকারের সাহায্য পেলে ভারতবর্ষ ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্পুর্ণ করে শুধু দেশের জন্য নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও কোভিড-19 এর ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে সক্ষম হত।
পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা সম্পন্ন ভারত কেন যথাসময়ে দেশের সব মানুষের টিকাকরণ করতে ব্যর্থ হল ?
প্রবীর পুরকায়স্থ
আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকেই প্রথম আত্মনির্ভরতার ধারনার উদ্ভব হয়।
এর অর্থ আমাদের দেশের অর্থনীতির ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে আমাদের দেশের মানুষ, প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পের নিজস্ব দক্ষতা উন্নততর করা।
প্রথম আত্মনির্ভরতা একচেটিয়া বহুজাতিক কোম্পানি - বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর একাধিপত্য ভেঙে ফেলা এবং জেনেরিক ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠা হল, যেগুলো ভারতকে দুনিয়ার দরিদ্রদের ঔষধ তৈরির প্রতিষ্ঠান তৈরিতে সাহায্য করল। ১৯৭০ সালে ভারতীয় পেটেন্ট আইন অনুসারে CSIR গবেষণাগারগুলো ওষুধের বিকল্প তৈরি করেছেন
এইভাবেই ভারতীয় সরকারি সংস্থা এবং অন্যান্য দেশিয় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন এবং জেনেরিক ওসুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা হিসেবে উন্নত হয়েছে।
বর্তমানে "আত্মনির্ভরতার" মোদি সংস্করণ এক নতুন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ভারতের কোভিড -19 সংকট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থা সিরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া WHO র কো-ভ্যাক্স প্লাটফর্মে এই বছরের শেষে পুনরায় ভ্যাকসিন তৈরি সম্পুর্ণ করতে পারার সম্ভাবনা কম । কেন ?
UNICEF এর বক্তব্য অনুসারে সিরাম ইন্সটিটিউট জুনের মধ্যে ১৮০ মিলিয়ন তৈরির কথা এবং আরো ২০০ মিলিয়ন ডিসেম্বর এর মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরির কথা যা তারা করে উঠতে পারবে না। এটা অন্য সব দেশের ক্ষেত্রেও একটা বিরাট ঘাটতি হল যারা covax platform এ তাদের ভ্যাকসিন চায়। ভারতীয় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারীদের উৎসাহিত না করে মোদির 'আত্মনির্ভরতা' প্রমান করল যে ভারত পৃথিবীর ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী হিসাবে খুব একটা উপযুক্ত নয়।
কি করা যেতে পারত? ভারতবর্ষের আলাদাভাবে কি করা উচিত ছিল ?
গত মোটামুটি কম সংক্রমণের পাঁচ মাস (অক্টোবর '20 থেকে ফেব্রুয়ারি'21) হাসপাতাল , অক্সিজেন, এবং অন্যান্য মেডিকাল সাপোর্ট ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরির ব্যবস্থার জন্য ব্যবহার করা যেত !
আমাদের দেশের প্রায় ৫০টা কোম্পানি ভ্যাকসিন বানাতে পারে। ঠিকমত পরিকল্পনা এবং সরকারের সাহায্য পেলে ভারতবর্ষ ভ্যাকসিন উৎপাদন সম্পুর্ণ করে শুধু দেশের জন্য নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও কোভিড-19 এর ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে সক্ষম হত।
উচিত ছিল দুটি বিশ্ব পরিক্ষিত ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি দিয়েই শুরু করে দেওয়া এবং যা আমাদের দেশের বিপুল ক্ষমতা আছে।
গত একশ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের ভ্যাকসিন আছে। এগুলো এখনো কাজ করে । ICMR - ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন , সিনোভ্যাকের করোনাভ্যাক , সিনোফার্মার BBIBP-CorV এগুলো সব নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ভ্যাকসিনের উদাহরণ । দ্বিতীয় যে প্রযুক্তি ব্যবস্থা যা একটা শান্ত ভাইরাস যা একটা adenovirus vector কে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে যা সার্স , কোভিড -2 মানে যেগুলো কোভিড-19 এর কারন।
উল্লেখযোগ্য কোভিড অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন গুলো হল ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট এ তৈরি Oxford-AstraZeneca এর Covishield , Gamaleya Institute এর
Sputnik V , এবং Cansino এর Convidicea .
আমরা কেউ mRNA প্রযুক্তি নিয়ে এখানে আলোচনা করছি না। এমনকি অন্য DNA অথবা sub-unit protein প্রযুক্তি নিয়েও আলোচনা হচ্ছে না। এগুলো সব নতুন প্রযুক্তি এবং অবশ্যই বেশ কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে । সবচেয়ে সহজ কাজ পরীক্ষিত নিষ্ক্রিয় ভাইরাস বা adenovirus vector vaccines নিয়ে প্রচুর উৎপাদন করা । এই প্রযুক্তিগুলো সবার জানা এবং ভারতের প্রচুর উৎপাদন ক্ষমতা আছে।
এই নিষ্ক্রিয় ভাইরাস প্রযুক্তি ভারতের মুম্বাই হফকিন ইন্সটিটিউটে প্রথম শুরু হয় এবং এর ১০০ বছরের ইতিহাস আছে। ১৮৯৩ সালে লুই পাস্তুরের ছাত্র ওয়াল্ডিমার হফকিন ভারতে এসেছিলেন এবং মুম্বাইতে হফকিন ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।
১৯৩২ সালে সাহিব সিং সোখে এর প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর হন। তিনি এটাকে উন্নত জৈব প্রযুক্তি সংস্থায় পরিণত করেন এবং অবশ্যই ভ্যাকসিন প্রস্তুত শুরু করেন।
মহারাষ্ট্র সরকারের অধীনস্থ Haffkine Bio Pharmaceutical যা হফকিন ইন্সটিটিউটে
পরিণত হয় এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ভ্যাকসিন সরবরাহকারী সংস্থায় পরিণত হয়।
এই সেই ভ্যাকসিন উৎপাদন ব্যবস্থা যা সিরাম ইন্সটিটিউট ব্যবহার করে। এখানকার সমস্ত বৈজ্ঞানিক কর্মীদের নিয়েছে , যার মধ্যে তিনজনের বোর্ডের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে।
ভারতের ভ্যাকসিন প্রস্তুতির দুঃখের যায়গা এটাই যে এটা সরকারের অধীনে তৈরি হয়েছে , একদা প্রাইভেট সংস্থা এসেছে এবং ধীরে ধীরে অধিকার করে নিয়েছে। এ সত্ত্বেও ভারতে সাতটা public sector আছে , জনগনের বেঁচে থাকার ভ্যাকসিন প্রাইভেট সংস্থা তৈরি করছে।
ভারতে বিশাল ভ্যাকসিন তৈরির ইতিহাস আছে। এই কোভিড -19 আসার আগে পর্যন্ত ভারত পৃথিবীর ৬০% ভ্যাকসিন তৈরি করে বিক্রি করত। CDSCO ( Central Drugs Standard Control Organisation) এর মত অনুসারে ভারতে ২১টা ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক সংস্থা আছে এবং বছরে এদের সংযুক্ত লাইসেন্সড উৎপাদন ক্ষমতা ৮ বিলিয়ন ডোজের বেশি।
সবচেয়ে বড় ভুল
এত বিরাট ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও ভারত এখন কেন মাসে মাত্র ৬০-৭০ মিলিয়ন ডোজ বানাচ্ছে ? সবচেয়ে বড় ভুল কেন্দ্রীয় সরকার ভেবেছিল এরা মহামারী থামিয়ে দেবে , তারপর ধীরে ধীরে জনগণকে ভ্যাকসিন দিতে পারবে। ভেবেছিল সিরাম ইন্সটিটিউট এর ৭০-১০০ মিলিয়ন এবং ভারত বায়োটেকের ১২.৫ মিলিয়ন প্রতি মাসে যথেষ্ট । ভারতের প্রয়োজন মিটিয়ে যা বাইরে পাঠানো যাবে। ২০২১ এর ৮ই মার্চ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের স্টান্ডিং কমিটিকে সরকারের পক্ষ থেকে এই তথ্য দেওয়া হয়েছিল । অথচ এখন আসল সংখ্যা যা জানা যাচ্ছে তা আরো কম , মাসে ৬০ মিলিয়ন।
সুতরাং এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে ভারতের জনসংখ্যা অনুযায়ী ২ বিলিয়ন ভ্যাকসিন তৈরি করতে দুই থেকে আড়াই বছর লাগবে।
অবশ্যই কোনো রপ্তানি করা যাবে না। এর মধ্যে শুধু তৃতীয় বা চতুর্থ ঢেউ আসার সমস্যা নয় , এদেশ গোটা পৃথিবীর ভ্যাকসিন বাজার থেকে সরে যাবে।
মোদি সরকার ভেবেছিল তারা মহামারী রুখে দিতে পেরেছে । ফলে তার মন্থর টিকাকরণের ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা হবে না ভেবেছিল ।
কেউ বুঝতেই পারছে না পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ ভ্যাকসিন বানাতে পারে তারা এই সময় যে ব্যবস্থা নিল তা ভারত নিল না কেন ?
১) প্রথমেই অগ্রিম অর্ডার দেওয়া
২) প্রস্তুতকারী সংস্থার জন্য এবং তাদের কাজ বাড়ানোর জন্য ব্যাঙ্ক লোনের পরিমাণ বাড়ানো।
৩) স্থায়ী সরকারি সংস্থাগুলোতে exchequer এর কাছ থেকে টাকা বিনিয়োগ করানো
৪) সিরাম ইন্সটিটিউট কে দেশিয় Covaxin এর অর্ডার জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে
মাত্র ১১ মিলিয়ন কেন দেওয়া হল ?
অথচ অতিরিক্ত ১২০ মিলিয়ন এল মার্চের শেষে যখন দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে এবং হু হু করে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ছে।
দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার পর এটা সিরাম ইন্সটিটিউট আর ভারত বায়োটেককে তাদের উৎপাদন বহু গুনে বাড়াবার অর্ডার দেওয়া হল।
আগে অর্ডার দিলে কত খরচ হত ? ৩০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে ভারত ১ বিলিয়ন আরও বাড়তি ডোস উৎপাদনের দক্ষতা অর্জন করে থাকত। ৬০০০ কোটি হলে ২বিলিয়ন আর ৯০০০ কোটিতে ৩বিলিয়ন যা দিয়ে দেশের সব মানুষকে ১২ মাসের মধ্যে ভ্যাকসিন দিয়েও আমরা সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক হতে পারতাম।
যদি এই কাজগুলো হত তাহলে
যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, টাকা নিয়েছিল তারা তাদের কথা রাখতে পারত । এইভাবেই ৯২টি দেশে আমাদের WHO এর covax programme অনুযায়ী ভ্যাকসিন সরবরাহ করা যেত।
এ বছর বাজেটে অর্থমন্ত্রী ৩৫০০০ কোটি টাকা কোভিড -19 ভ্যাকসিন খাতে বরাদ্দ করেছেন। এর এক তৃতীয়াংশ এর কিছু কম
খরচ করতে পারলে বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে সবাইকে দিয়ে রীতিমতো রপ্তানি করা যেত।
শুধু মাত্র আমরা আমাদের দেশের জনগণকে হতাশ করলাম না , , ৯২ টা দেশকে ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত করলাম। এই হচ্ছে মোদীজীর "আত্মনির্ভর" ভারতের ফল। আদতে আমাদের নিজেদের ক্ষমতার অপচয় এবং সর্বোপরি সমস্ত জনগণকে রাস্তায় এনে দাঁড় করানো হল।
*********************
(অনুবাদ - চিরন্তন গাঙ্গুলী)
ছবি- সিরাম ইন্সটিটিউট এর কর্মীরা
We hate spam as much as you do