দিবসের মূল ধারণাটি আসে ভ্যালেন্সীয় লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে। তিনি তার প্রিয় লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেসকে সম্মান জানানোর একটি উপায় হিসাবে ধারণাটি দেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজা আলফনসো ত্রয়োদশ স্পেন জুড়ে স্পেনীয় বই দিবস পালনের জন্য একটি রাজকীয় ফরমান জারি করেন। পরে সমগ্র স্পেনে দিবসটি পালন করা শুরু হয়। প্রথমে ৭ অক্টোবর থের্ভান্তেসের জন্মদিনে দিবসটি পালন শুরু হয়, পরে তা তার মৃত্যুদিন ২৩ এপ্রিলে স্থানান্তর করা হয়।
বিশ্ব বই দিবস সঙ্গে কপিরাইট দিবসে বই নিয়ে হৈ চৈ
বিশ্ব বই এবং কপিরাইট দিবস ২০২২, যা সাধারণত বিশ্ব বই দিবস বা আন্তর্জাতিক বই দিবস হিসাবে পরিচিত, প্রতি বছর ২৩শে এপ্রিল পালন করা হয়। জাতিসংঘের শিক্ষাগত, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (UNESCO) দ্বারা এমন একটি দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যা পাঠ, প্রকাশনা এবং কপিরাইটিংয়ের প্রচার করে। প্রথম বিশ্ব বই দিবস ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল পালিত হয়েছিল। আসুন এই নিবন্ধটি থেকে বিশ্ব বই এবং কপিরাইট দিবস ২০২২ যেমন এর ইতিহাস, তাৎপর্য, উদযাপন ইত্যাদি সম্পর্কে কিছুটা শিখি।
বই হলো এমন একটি মাধ্যম, যার মধ্যে মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞান, দর্শন-উপলব্ধি আর আবেগ-অনুভূতি সন্নিবেশিত হয়ে থাকে। বর্ণমালা বা হরফ উদ্ভাবনের পর থেকে মানুষ নিজেদের চিন্তা-ভাবনাকে বইয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা শুরু করেছে। পশুর চামড়া, গাছের ছালবাকল, মাটি- পাথরের পাত সআর শিলালিপিতে উৎকীর্ণ হতে থাকে সেসব। তারপর নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এখন চলছে মলাটবদ্ধ বইয়ের যুগ।
বিশ্ব বই দিবস বা বিশ্ব গ্রন্থ দিবস হলো পড়া, প্রকাশনা এবং কপিরাইট প্রচারের জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন (ইউনেস্কো) দ্বারা আয়োজিত একটি বার্ষিক দিবস। ২৩ এপ্রিল ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো প্রথমবারের মত বিশ্ব বই দিবস উপযাপন করে। এরপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। একটি সম্পর্কিত দিবস যুক্তরাজ্য এবং আয়ারল্যান্ডে মার্চ মাসে পালন করা হয়। এছাড়াও বিশ্ব বই এবং কপিরাইট দিবস, বা বইয়ের আন্তর্জাতিক দিবস নামেও পরিচিত দিনটি।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্ব বই এবং কপিরাইট দিবস উদযাপিত হবে ২৩ এপ্রিল। যেহেতু দিনটি ইংরেজ উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, পেরুভীয় ইনকা গার্তিলাসো দে লা ভেগা, এবং স্পেনীয় মিগেল দে থের্ভান্তেসসহ আরো বিশিষ্ট লেখকের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী। ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমে শেকসপিয়ার ও থের্ভান্তেস একই তারিখে মারা যান (২৩ এপ্রিল ১৬১৬) কিন্তু একই দিনে নয়, যেহেতু সেই সময় স্পেনে গ্রেগরীয় পঞ্জিকা ব্যবহার করা হতো এবং ইংল্যান্ডে জুলীয় পঞ্জিকা ব্যবহার করা হতো। আর শেক্সপীয়ার প্রকৃতপক্ষে থের্ভান্তেসের মৃত্যুর ১০ দিন পরে মারা যান, গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় যা ৩ মে।
স্পেনের কাতালোনিয়াতে, সেন্ট জর্জ দিবস (দিয়াদা দে সান্ত জর্দি, এই ঐতিহাসিক অঞ্চলের সন্ত অনুগ্রাহক) ১৪৩৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পালন করা হচ্ছে এবং এতে প্রিয়জন এবং সম্মানিত ব্যক্তিদের মধ্যে উপহার বিনিময়ের প্রথা জড়িত রয়েছে। কাতালোনিয়াতে সেন্ট জর্জ দিবসটি প্রিয়জনকে বই এবং গোলাপ প্রদানের মাধ্যমে উদ্যাপন করা হয় এবং এটি কাতালোনীয়দের তাদের অনুগ্রাহক সন্তদের প্রতি সম্মান এবং সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের একটি সুযোগ।
সুইডেনের দিনটি বার্ডসবোকড্যাগেন Världsbokdagen (বিশ্ব বই দিবস) নামে পরিচিত। সাধারণভাবে এটি ২৩ এপ্রিল উদ্যাপন করা হয়। তবে এটি ইস্টারের সাথে সংঘর্ষ এড়াতে ২০০০ এবং ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তা ১৩ এপ্রিলে নেয়া হয়েছিল।
শরীর সুস্থ রাখার জন্য যেমন স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন, ঠিক তেমনিভাবেই ব্রেন তথা মস্তিষ্ককে সুস্থ, কার্যক্ষম ও সচল রাখার জন্য খাদ্য দেয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণা জানাচ্ছে, বই পড়ার অভ্যাসটি হলো মস্তিষ্কের খাদ্য।
মস্তিষ্কের জন্য সবচেয়ে উপকারী ও কার্যকর হলো বই পড়ার অভ্যাস। বই পড়া ব্রেনের জন্য উপকারী, এর পেছনে আসলে খুব বড় কোন রহস্য নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউসিএলএ সেন্টার ফর ডিসলেক্সিয়ার ডিরেক্টর বলেন, ‘ভাষা শেখা কিংবা কোন কিছু লেখার চাইতেও বই পড়ার সময় একজন পড়ুয়া অনেক বেশি চিন্তাভাবনা করেন। যা তাকে কাল্পনিক জগতে বিস্তৃতভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দেয়, চিন্তার নতুন অনেক দ্বার খুলে দেয়। এতে করে ভাষা শেখার চাইতেও অনেক বেশি উপকৃত হয় মস্তিষ্ক।
আরও দারুণ বিষয় জানাচ্ছে ইমোরি ইউনিভার্সিটি। এই ইউনিভার্সিটির এক গবেষণাপ্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা গেছে, বই শেষ বই পড়ার পাঁচ দিন পরেও মস্তিষ্কে তার কার্যকারিতা চলতে থাকে।
আরও একটি বিষয়টি জেনে দারুণ চমৎকৃত হবেন। বইয়ের গল্পে যে কাজের বিবরণ দেয়া থাকে, মস্তিষ্ক সে কাজটির অনুভূতি গ্রহণ করে সেই রূপ কাজ করে। ধরুন আপনি বইয়ে ঘোড়ায় চড়ার কাহিনি পড়ছেন। মস্তিষ্ক সে অনুভূতি হিসেবে সেভাবে কাজ করবে।
শারীরিক কোন কাজের কথা পড়ার সময় নিউরন সেইরূপভাবে কাজ করা শুরু করে। এক্ষেত্রে দায়ী হলো মোটোর নিউরন ফাংশন। বলা যেতেই পারে, বই পড়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কের দারুণ ব্যায়ামও হয়ে যায়।
বিশ্ব বই দিবসের মাধ্যমে ইউনেস্কো সৃজনশীলতা, বৈচিত্র্য এবং জ্ঞানের ওপর সকলের অধিকারের বিষয়টিকেই উৎসাহিত করে। সকলের কাছে শিক্ষা ওই বই পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে বিশ্বব্যাপী বইপ্রেমী সব মানুষ, বিশেষ করে লেখক, শিক্ষক, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং গণমাধ্যম একটি মঞ্চ তৈরির চেষ্টা করে মূলত, যাতে শিক্ষার উন্নয়ন ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
আগামীকাল ২৩ এপ্রিল বিশ্ব কপিরাইট দিবসও। কপিরাইট মানে হলো মেধাস্বত্ব। মেধা সম্পদের সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষণের নামই হলো কপিরাইট।
কপিরাইট দ্বারা মেধাসম্পদের ওপর প্রণেতার নৈতিক ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ওই মেধাসম্পদ বিভিন্ন পন্থায় পুনরুৎপাদন, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ, লাইসেন্স প্রদান এবং জনসমক্ষে প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে প্রণেতা বা সৃজনশীল ব্যক্তি একচ্ছত্র অধিকার লাভ করেন।
মেধাসম্পদের আইনগত স্বীকৃতি প্রদান, উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা নিশ্চিতকরণ এবং এই আধুনিক যুগে পাইরেসি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কপিরাইট সংরক্ষণ, রয়্যালটি আদায় এবং ব্রডকাস্টিং অর্গানাইজেশন থেকে ট্রান্সমিশন এবং রিট্রান্সমিশন সঠিকভাবে নিশ্চিতকরণে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো প্রতি বছর ২৩ এপ্রিলকে বই দিবসের পাশাপাশি সব দেশে কপিরাইট দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান জানান। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি উদযাপন শুরু হয়।
We hate spam as much as you do