পশ্চিমবঙ্গের বহু নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত অংশেরই রোজগার আর আর্থিক পরিস্থিতি প্রশ্নের মুখে স্রেফ গনপরিবহন বন্ধের ফলে। তাঁদের রোজগারের জন্য যাতায়াতের একমাত্র ভরসা লোকাল ট্রেন।
ট্রেন না চললে আর যে চলছে না। এবার থেকে চলুক বাবু!
ঝর্না মণ্ডলের, বাসস্থান গোচরনে। পেশা কলকাতার বাবুদের বাড়িতে কাজ করা। রোজ সকালে ফার্স্ট ট্রেন ধরে ঢাকুরিয়াতে আসে। তারপর সাতবাড়ি কাজ করে সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়িতে ফেরা। কিন্তু ২০২০ এর মার্চের লকডাউন তাঁর কাজে প্রথম থাবা বসাল। তারপর যাও কড়াকড়ি কমল, ট্রেন না চলায় কাজে যাওয়া বন্ধ। ঘরে অভাব-অনটন নিত্যসঙ্গী। ট্রেন চালু হলেও আগের সব বাড়িতে কাজ ফেরেনি। গতবছরের ক্ষত শুকোনোর আগেই ফের করোনার কারণে লকডাউন, সাথে রোজগারেও তালাবন্দি। জুনের মাঝামাঝি নিয়ম শিথিল হলেও ট্রেন-বাস সব বন্ধ। বাবুরা কেউই বিনা কারণে টাকা দিতে রাজি নয়। ঝর্না বুঝতে পারছে না সে কি করবে, কি করে সংসারের এতোগুলো মুখে খাবারের ব্যবস্থা করবে। তাঁর কাছে ট্রেন বন্ধ মানেই রোজগারও বন্ধ।
শুধু ঝর্না নয়, পশ্চিমবঙ্গের বহু নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত অংশেরই রোজগার আর আর্থিক পরিস্থিতি প্রশ্নের মুখে স্রেফ গনপরিবহন বন্ধের ফলে। তাঁদের রোজগারের জন্য যাতায়াতের একমাত্র ভরসা লোকাল ট্রেন। বলতে গেলে দক্ষিণ বাংলার বিস্তীর্ণ অংশের একমাত্র লাইফলাইন হল এই লোকাল ট্রেন পরিষেবা। কলকাতায় চাকরি করতে বা ব্যবসার সূত্রে তো বটেই, এমনকি শহরের সবজী-মাছ-দুধ-ফুলের সাপ্লাই বা গ্রামের অসুস্থ রোগীকে শহরের হাসপাতালে আনার ক্ষেত্রেও অন্যতম ভরসা এই লোকাল ট্রেন পরিষেবা। কিন্তু মহামারীর প্রেক্ষিতে সরকারের লোকাল ট্রেন বন্ধের সিদ্ধান্ত এই সকলের মানুষের জীবন-জীবিকায় কার্যত দাঁড়ি টেনে দিয়েছে। যার ফলে তাদের ঘরে কার্যত হাঁড়ির হাল। যাদের সামান্য কিছু সামর্থ্য আছে, তারা প্রতিদিন কেবলমাত্র চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিরাট অঙ্কের টাকা খরচ করে আর বিপুল সময়ের অপব্যয়ের বিনিময়ে কর্মস্থলে পৌঁছয়। আর যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তাঁদের সামনে রোজগার হারানোর আশঙ্কা ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। যারা ট্রেনে হকারি করে বা গ্রাম থেকে শহরে এসে দৈনিক রোজগারের ভিত্তিতে জীবনধারন করে, তাদের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। এদের অনেকের রেশন কার্ড থাকলেও নিয়মিত রেশন পান না। অনেকের জবকার্ড নেই, থাকলেও স্থানীয় প্রশাসনের দৌলতে কাজের দেখা নেই। গ্রামের বা মফঃস্বলের সবজী নষ্ট হচ্ছে স্রেফ লোকাল ট্রেন বন্ধ থাকার কারনে। ফলে চাষিদেরও মাথায় হাত।
হ্যাঁ, সরকারের যুক্তি আছে এক্ষেত্রে। তা হল এই যে ট্রেন চললে লোকসমাগম হবে, আর থেকে করোনার সংক্রমন বাড়তে পারে। এই যুক্তি চিকিৎসাশাস্ত্রের দিক থেকে সঠিক মেনেও এই প্রশ্ন তুলতে আমরা বাধ্য হচ্ছি যে তাহলে লকডাউন কি কেবলমাত্র সাধারন মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ? উচ্চবিত্তের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে নয় ? সাম্প্রতিককালে সংক্রমন হ্রাস পেয়েছে এই যুক্তিতে সরকার পানশালা খুলে দেওয়ার নির্দেশ দিল। কিন্তু সংক্রমনের দোহাই দিয়ে গণপরিবহন বন্ধ রাখার নির্দেশ বহাল রইল, যেখানে বেসরকারি ক্ষেত্রে আংশিক কাজকর্মের অনুমতি দেওয়া হয়েছে আর সরকারী ক্ষেত্রে অধিকাংশ পরিষেবা জরুরী ভিত্তিতে চালু আছে। এক্ষেত্রে কর্মচারীদের দুটো রাস্তা, হয় স্টাফ স্পেশাল ট্রেনে বাদুড়ঝোলা ভিড়ে রেল্পুলিশের মারের ভয় মাথায় নিয়ে যাতায়াত করা না হয় বিপুল টাকা খরচ করে কর্মস্থলে পৌঁছানো। কিন্তু তাতে মধ্যবিত্ত সংসার নানান সংকটের সম্মুখীন। আর নিম্নবিত্ত বা দৈনিক রোজগারের উপর নির্ভরশীলদের কথা ছেড়েই দিলাম। ২০২০ এর সেপ্টেম্বরে সিঙ্গুরে সড়ক দুর্ঘটনায় এক যুবকের মৃত্যু সেই প্রশ্নগুলি তুলেছিল। প্রশ্ন উঠেছিল স্বাভাবিক সময়ের থেকে অতিরিক্ত ট্রেন চালু করে কি এই সমস্যার সমাধান করা যেত না? হ্যাঁ, সরকার যুক্তি তুলেই পারে যে লোকবল কম। কিন্তু আমাদের সোজা প্রশ্ন স্রেফ বেসরকারিকরনের লক্ষ্যে রেলের নিয়োগ কমিয়ে কি রেলকে রুগ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে, যার ফল এই দুর্যোগের সময় দেখা যাচ্ছে?
এই প্রসঙ্গে সামগ্রিকভাবে আমাদের বক্তব্য সমস্ত রকম সুরক্ষাবিধি মেনে গণপরিবহন, বিশেষত লোকাল ট্রেন পরিষেবা চালু করা হোক। কারণ তার সাথে বহু লোকের রোজগারের প্রশ্ন জড়িত। না হলে তথাকথিত জনপ্রিয় সরকারের বিরুদ্ধে সবহারানো মানুষ রাস্তায় নামবেই, যার আভাস মিলেছে সোনারপুরে ২৩শে জুনের সকালে।
ঝর্ণা মন্ডল - (কল্পিত নাম, কিন্তু বাস্তব চরিত্র )
We hate spam as much as you do