সওকাত ওসমানী তাসখন্দে ১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই শওকত ওসমানীই ভগৎ সিং এর সাথে স্ট্যালিনের যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন। যে ওসমানীকে ভারতে এম এন রায় পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। তৎকালীন হিন্দি পত্রিকা "প্রতাপ" যা ১৯২০ সালে কানপুর থেকে প্রকাশিত হতো,এর সম্পাদক স্বনামধন্য ব্যক্তি গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর মাধ্যমে ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করেন।
মাঝখানের ছবি শওকত ওসমানী যিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন স্তালিনের সাথে ভগত সিং এর যোগাযোগ করিয়ে দেন
স্ট্যালিন ভগৎ সিংকে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আমন্ত্রণ করেছিলেন।
প্রবাল শরণ আগরওয়াল, হর্ষবর্ধন
PhD scholars at JNU.
(Newsclick এ গতবছর প্রকাশিত)
বঙ্গানুবাদ - চিরন্তন গাঙ্গুলী
(গতকাল ৫ই মার্চ ছিল স্টালিনের মৃত্যুদিন। ভারতের বিপ্লবী শহীদ ভগৎ সিং এর সাথে মিলিত হতে চেয়েছিলেন তার বিভিন্ন যোগাযোগ ও তথ্যসহ এই লেখা )
ভগৎ সিং, সুখদেভ, রাজগুরুর ৯০ তম শহীদ দিবসে ইতিহাসের এক অনুচ্চারিত অধ্যায়ের আলোচনা শুরু হল।
ইতিহাসে এই ঘটনা খুব কমই উল্লিখিত যে স্ট্যালিন ভগৎ সিংকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ডেকেছিলেন।
এটা ঠিক যে ভগৎ সিং এর কাছে এই আমন্ত্রণ পৌঁছয়নি। পৌঁছলে এবং ভগৎ সিং সোভিয়েত ইউনিয়নে গেলে ইতিহাসের চাকা যে অন্য দিকে ঘুরত তার কোন সন্দেহ নেই।
সওকাত ওসমানী তাসখন্দে ১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একজন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। এই শওকত ওসমানীই ভগৎ সিং এর সাথে স্ট্যালিনের যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন। যে ওসমানীকে ভারতে এম এন রায় পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। তৎকালীন হিন্দি পত্রিকা "প্রতাপ" যা ১৯২০ সালে কানপুর থেকে প্রকাশিত হতো,এর সম্পাদক স্বনামধন্য ব্যক্তি গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থীর মাধ্যমে ভারতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করেন।
ভগৎ সিং সেই পত্রিকার sub-editor হিসাবে কাজ করতেন। এমনকি তিনি ওসমানীর পেশোয়ার থেকে মস্কো রাজনৈতিক পরিভ্রমণের খবর এডিট করেছেন যা অল ইন্ডিয়ান মুহাজিরীন ডাইরি নামে পরিচিত। তাছাড়া ওসমানী যিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি সমস্ত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন
১৯২৮ সালে ওসমানী কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এর ষষ্ঠ কংগ্রেসে যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। তিনি ভগৎ সিং এবং তার খুব ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিজয় কুমার সিনহা দু'জনকেই সোভিয়েত ইউনিয়নে আমন্ত্রণ করেছিলেন।
ওসমানী এই ঘটনায় লিখেছেন আমি ঠিক মনে করতে পারছিনা আমি ঠিক কবে প্রথম ভগৎ সিংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলাম, সেই সময় দ্য হিন্দুস্তান রিপাবলিকান HRA সবেমাত্র হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান HSRA অ্যাসোসিয়েশন পরিবর্তিত হয়েছিল এবং এই নতুন সংগঠন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সাথে যোগাযোগ রেখেছিল। আমাকে জানানো হয় যে ব্যক্তিগতভাবে সশস্ত্র কাজ ছেড়ে একসঙ্গে তাদের তালিকা অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রামে যাবে আমি ভগৎ সিংকে বলেছিলাম "মস্কো চলো"। আমি বিশ্বাস করেছিলাম ভগৎ সিং এবং বিজয় সিনহার উপস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীনতা সংগ্রামে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে।।
ভগৎ সিংয়ের সাথে বিজয় কুমার সিনহা HSRA এর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দায়িত্বে ছিলেন।
বিজয় সিনহা তার বই "নিউ ম্যান ইন সোভিয়েত ইউনিয়ন " এতে ওসমানীর এই আমন্ত্রণের কথা লেখা আছে । ওসমানী ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ষষ্ঠ কংগ্রেসের যোগ দেওয়ার জন্য। বিজয় সিনহা লেখেন, ওসমানী আমাকে এবং আমার সহযোগীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে তার সাথে যেতে, ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতিনিধি হিসাবে। আমি ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করি এবং আমরা বুঝি এটা দেশ ছেড়ে যাবার সময় নয় আমরা পরবর্তীকালে আমাদের কাজ সম্পন্ন করার পরে মস্কো যাব।।
oil painting of communist internatioanal 6th congress
ওসমানী ভগৎ সিং এবং সিনহাকে সোভিয়েত ইউনিয়নে HSRA প্রতিনিধিত্ব করতে আমন্ত্রণ করেছিলেন এ কথা স্বয়ং মুজাফফর আহমেদ তাঁর বইতে লিখেছেন "আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি " তিনি আরো লিখেছেন সিনহা ওসমানীকে এই যাত্রার জন্য ২০০ টাকা দিয়েছিলেন যখন ওসমানী নিশ্চিত করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে তিনি আর্থিক সাহায্য এনে দেবেন।
ওসমানী ১৯২৮ তে সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার যান যেখানে তিনি ষষ্ঠ কংগ্রেসের প্রেসিডিয়ামে বসার সুযোগ পান। এই সম্মেলন ১৭ ই জুলাই ১৯২৮ শুরু হয়েছিল ১লা সেপ্টেম্বর ১৯২৮ শেষ হয়েছিল। আশ্চর্যজনকভাবে এখানে উপনিবেশিক প্রশ্নে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মির ভূমিকা আলোচিত হয়েছিল এবং এই সম্মেলন হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি কে একজন প্রকৃত বিপ্লবী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন বলেছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস একটা পেটিবুর্জোয়া রাজনৈতিক দল তারা তাদের ভূমিকা পালনে ব্যর্থ তারা শুধুমাত্র রিফর্মিস্ট এর ভূমিকা পালন করছে।।
কমিন্টার্ন লক্ষ্য করেছিল ভারতে গান্ধীবাদ একটা প্রগতিশীল পেটিবুর্জোয়া আদর্শের আন্দোলন । ক্রমে ক্রমে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তো এরপরে ভারতে আরো অনেক প্রগতিশীল বিপ্লবী দল এইসব বুর্জোয়া দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছিল কমবেশি জাতীয় বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল
দুর্ভাগ্যজনকভাবে উসমানী মস্কো থেকে ফেরার পর মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয় যে মামলা ১৯২৯ এর মার্চে শুরু হয়েছে এর মধ্যে ভগৎ সিং এবং তার কমরেডরা ১৯২৮ ডিসেম্বরে জন স্যান্ডার্স কে হত্যা করে, এরপরে মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হওয়ার পর ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত HRA পক্ষ থেকে সেন্ট্রাল এসেম্বলি হলে বোমা ফাটায় তাদের দাবি ছিল শ্রমিক বিরোধী জননিরাপত্তা বিরোধী শ্রম আইন এর বিরুদ্ধে এবং তারা গ্রেফতার হয়।
. উল্লেখ্য সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলি হলে বোমা ছোড়ার সিদ্ধান্তের আগে HSRA এ নেতারা ভেবেছিলেন ভগৎ সিংকে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠানো যেতে পারে কারণ লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি ইতিমধ্যেই আত্মগোপন করেছিলেন।
সিদ্ধান্ত হয়েছিল অন্য কোন বিপ্লবী এই বোম ছুড়বে যদিও পরবর্তীকালে ঠিক হলো সুকদেব এবং ভগৎ সিং সঠিকভাবে তাদের পার্টির লক্ষ্য এবং আদর্শের কথা সংবাদমাধ্যমের সামনে সঠিকভাবে উপস্থিত করতে পারবে সেই জন্য তারাই বোমা নিক্ষেপ করবে। HSRA নেতৃত্ব বুঝতে পারেনি যে ওসমানী সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য আমন্ত্রণ পত্র নিয়ে এসেছে , এমনকি সবার গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার ফলে ভগৎ সিং এবং HSRA এর প্রতি স্ট্যালিনের মেসেজ সকলকেজানানো যায়নি
পরে ওসমানী নিউ দিল্লি থেকে প্রকাশিত "নয় জামিন "নামক এক হিন্দি পত্রিকার একটি প্রবন্ধে লেখেন, যে তিনি ভারতে আসার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন জোসেফ স্ট্যালিন তাকে বলেন ভগৎ সিংকে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসতে বলুন। ওসমানের বক্তব্য অনুযায়ী স্ট্যালিন "
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে স্ট্যালিন ভগৎ সিং সম্পর্কে জানেন কি করে?
ভগৎ সিং এর আত্মজীবনী কার বিরেন্দর সিন্ধু যিনি ভগৎ সিং এর ভাগ্নে সম্ভবত প্রাক্তন গদর বিপ্লবী বাবা সন্তোজ সিং এবং বাবা গুরুমুখ সিং যারা পাঞ্জাবের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন তাদের কাছ থেকেই কমিন্টার্ন এবং স্ট্যালিন, ভগৎ সিং সম্পর্কে জেনেছিলেন, এমনকি তারা ভগৎ সিংকে তাদের কীর্তি গ্রুপ এ যুক্ত করতে চেয়েছিলেন।
ভগৎ সিংয়ের এবং ভারতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি স্ট্যালিনের আকর্ষণের কারণ কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এর ষষ্ঠ কংগ্রেসে ভারত এবং চীনের মত উপনিবেশিক দেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামে কি রণনীতি এবং রণকৌশল নেওয়া যায় তার বিশদ আলোচনা হয়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ইতিমধ্যে হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন এর কথা জানতে পেরেছে এবং এটা মোটামুটি পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্বে একটি জাতীয় বিপ্লবী সংগঠন যা জাতীয় কংগ্রেসের বিকল্প।
ষষ্ঠ কংগ্রেস দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম বিষয়ে স্পষ্ট রণকৌশল এবং রণনীতি গ্রহণ করেছিল, উপনিবেশিক দেশগুলোর কমিউনিস্ট পার্টিকে এই কংগ্রেস প্রস্তাব দিয়েছিল যে এদের প্রত্যেককে রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে হবে, পেটিবুর্জোয়া গ্রুপ এবং পার্টিদের থেকে আলাদা অবস্থান নিতে হবে।
ষষ্ঠ কংগ্রেস এটাও বলে যে সাময়িকভাবে এই পেটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে একসঙ্গে সংগ্রাম করা যেতেই পারে। যদিও জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনে প্রকৃত বিপ্লবী আন্দোলন এবং যা শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সঠিক দিশা দিতে পারে এছাড়া এই গ্রুপ কৃষকদের এবং বিপুল অংশের বিপুল অংশের শোষিত জনগণের জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে কোন প্রতিবন্ধক হয়না।
হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি তে পরিণত হওয়ার পর ওসমানী জানতেন এই সংগঠন সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই করবে। সেই কারণে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে তিনি ভগৎ সিং কে আমন্ত্রণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা ভগৎ সিং এবং সিনহার গ্রেপ্তার হওয়াতে হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি সিদ্ধান্ত নেয় প্রবীণ গদর পার্টি নেতা প্রীতি সিং আজাদ মতাদর্শগত এবং সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন যাবেন কিন্তু আজাদ সেখানে সাথে সাথেই যেতে পারেননি তখন HSRA সুরেন্দ্র পান্ডে এবং যশপাল যিনি পরবর্তীকালে হিন্দি প্রাবন্ধিক হয়েছিলেন সেখানে তাদের পাঠানোর পরিকল্পনা হয়। এর মধ্যে ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে commander-in-chief চন্দ্রশেখর আজাদ এর আকস্মিক মৃত্যুতে এই পরিকল্পনা বাতিল হয়।
এরমধ্যে যশপাল কিছু মাসের জন্য এবং পান্ডে গ্রেপ্তার হয়।। মুক্তির পর পান্ডে HSRA কে কানপুরে পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টা করেন এবং সেখানে তিনি কমিউনিস্টদের সাথেই যোগাযোগ রেখে চলেন আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ভগৎ সিং এবং তার কমরেডরা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ১৯৩০ এ ২১শে জানুয়ারি লেনিন এর মৃত্যুতে শোক বার্তা পাঠান।
HSRA আরে সদস্যরা এরপরও সোভিয়েত ইউনিয়ন যাওয়ার চেষ্টা করেন তারপর ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়ার পর বিজয় কুমার সিনহা সোভিয়েত ইউনিয়ন যেতে সক্ষম হন
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
We hate spam as much as you do