শুধু ভাত কাপড়ের জোগাড় নয়, কখনো কখনো এর বাইরে রোজগারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রোগ নিরাময়, ওষুধ পত্র কেনার জন্য, বাড়িতে ভাই ও বোনের সংখ্যাও কম নয়, তাই তো সকলকে সামান্য পেট ভরানোর জন্য সেই শিশুটিকে মোটর গ্যারেজ, মিষ্টির দোকানে জোগারে হিসেবে পাঠাতে হয়।
১২ই জুন শিশুশ্রম বিরোধী দিবসে সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধির দাবী
শিশুশ্রম বিরোধী দিবস ২০২২। ১২ই জুন।
এ বছর দিবসটির থিম নির্ধারণ করা হয়েছে ‘শিশুশ্রম বন্ধে সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা’। থিমটি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থায় বিনিয়োগের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং দৃঢ় সামাজিক সুরক্ষা মেঝে স্থাপন এবং শিশু শ্রম থেকে শিশুদের রক্ষা করার পরিকল্পনা করেছে।
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আইন আছে, পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে কিন্তু কোন উৎকর্ষতা নেই। নেই কোনো পরিবর্তন। বাজারে, মোড়ে, রাস্তাঘাটে, দোকানে, বাড়িতে এখনো শিশুশ্রম রমরমিয়ে চলছে। শিশুশ্রমিকরা হা-হুতাশ গুমড়ে মরছে। গ্রামবাংলা থেকে ভারতের সমস্ত আধার শহর ও শহরের বুকে নিয়ে কখনো কখনো কিছু মানুষকে কিছু NGOকে দেখা যায় Anti child labour নিয়ে কাজ করতে তবুও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিষ্পলক চেয়ে থাকা শিশুশ্রমিকের দুটো চোখ ছল ছল করে ওঠে।
কেন হয় শিশুশ্রম
পরিবারের দারিদ্রতা এর কারন।
উপযুক্ত যোগ্যতর কাজের অভাব-
রোজগারি সদস্যের অভাব-
উপযুক্ত অভিভাবকের অভাব-
বসবাস যোগ্য উপযুক্ত পরিবেশ- ভরসাহীন শিক্ষা-
সরকারি উদাসীনতা-
জাতিবিদ্বেষ সমাজ-
মালিকপক্ষের চাহিদা- কমবেতনে চলে যায়
মুলত শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কি করনীয় |
ক. কর্মী নিয়োগ বৃদ্ধি |
খ. সরকারি প্রতিশ্রুতির নিশ্চয়তা |
গ. বিদ্যালয় সংখ্যা বৃদ্ধিি |
ঘ. সচেতনতা শিবির |
ঙ. আইন প্রনয়ণ |
ভারতের শিশু শ্রম বিরোধী আইন
শিশুশ্রম বিরোধী দিবস
১২ ই জুন শিশুশ্রম বিরোধী দিবস (উদযাপিত হবে আন্তর্জাতিকভাবে। ILO বা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন প্রথম শিশুশ্রম বিরোধী দিবস 2002 সালে উদযাপন করে। এবং জনসাধারণ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি নির্মাণ করে। তখন থেকে এই দিনটাকে শিশুশ্রম বিরোধী হিসেবে সারা পৃথিবীতে উদযাপিত হয়ে আসছে।
এ ব্যাপারে সমস্ত দেশ বেশ সাগ্রহে অংশগ্রহণ করে থাকে। একেবারে তৃণমূল স্তরে থেকে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস জারি থাকলেও আমাদের মানসিক নিষ্ঠুরতা কোথায় যেন লুকিয়ে আছে। বর্তমান শিশুশ্রম এখনো চলছে বেশ সমারোহে।
এর আগে দেখা যাক শিশুশ্রমের উদ্ভূত কারণগুলো। অনেক কিছু সামাজিক অর্থনৈতিক বিষয় রয়েছে যেগুলো বাধ্য করে একটি শিশুকে তার শৈশবকে অন্ধকারে রেখে মালিকের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে। আমরা সকলেই এর পেছনের কারণগুলো সম্পর্কে অবগত। তার কয়েকটি এখানে বলার প্রয়োজন মনে করি।
দারিদ্রতা
এটি অবশ্যই প্রথম কারণ। দারিদ্রতাই আমাদেরকে বাধ্য করে একজন শিশুকে তার কাছ থেকে শৈশবকে ছিনিয়ে নিয়ে তার শ্রম বিক্রি করতে। খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের মত প্রাথমিক চাহিদা মেটানোর জন্য শিক্ষা, শৈশব সবকিছু জলাঞ্জলি দিতে বাধ্য হয়। একটি পরিবার বাঁচার জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অবশ্যই প্রয়োজন খাদ্য। বিনা খরচে কেউ কাউকে খাবার জোগান দেবে না। তাই বাড়ির শিশুটিকে নিজের খাবার নিজেই জোগাড় করার জন্য কখনো, কখনো বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের খাবার জোগাড় করার তাগিদে শিশুরটিকে কাজ করতে বাধ্য হতে হয়। এক্ষেত্রে পুত্রকন্যার ভেদাভেদ থাকে না। ছেলেমেয়ে উভয়কেই মালিক কর্মী নিয়োগ করে। কখনো কখনো কেবলমাত্র দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য।
দারিদ্রতা কেন?
কর্মহীন মা বাবা-মা বাবার সামর্থ্য নেই কাজ করার। হয়তো রোগশয্যায় অথবা যেটুকু রোজকার তাতে পরিবারের সমস্ত সদস্যদের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার মতো নয়। তাইতো শিশুটিকে কোন দোকানে কাজ করতে পাঠাতে বাধ্য হয় তার নিজেরই মা-বাবা।
শুধু ভাত কাপড়ের জোগাড় নয়, কখনো কখনো এর বাইরে রোজগারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রোগ নিরাময়, ওষুধ পত্র কেনার জন্য, বাড়িতে ভাই ও বোনের সংখ্যাও কম নয়, তাই তো সকলকে সামান্য পেট ভরানোর জন্য সেই শিশুটিকে মোটর গ্যারেজ, মিষ্টির দোকানে জোগারে হিসেবে পাঠাতে হয়।
এরপর গুরুত্বপূর্ণ উপযুক্ত যোগ্যতর কাজের অভাব। পরিবারের কর্মঠ বা উপযুক্ত সদস্যদের উপযুক্ত কর্মহীনতা শিশুকে ত্বরান্বিত করে শিশুশ্রম এর জন্য। বাবা বা উপযুক্ত দাদা দিদিদের উপযুক্ত কাজের অভাব বা কাজ থাকলেও উপযুক্ত পারিশ্রমিক এর অভাবে সদস্যরা শিশুকে কাছে পাঠাতে বাধ্য হন। যদিও এখন NREGP প্রকল্পের সরকার নিশ্চিত করেছে কাজের, তবুও এর উপযুক্ত স্থান বা সারা বছর ব্যাপী কাজের অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। ফলে শিশু বাধ্য হয় কোন মালিকের অধীনে কাজ করতে।
পরিবার হয়তো প্রয়োজনীয় ব্যক্তির অভাবে ঝুঁকছে। বাবা, মা বা নির্ভরযোগ্য কোনো সদস্য নেই যার উপর পরিবার ভরসা পায়। মা-বাবা সেরকম রোজগার করে না। অথবা একেবারে রোজগারহীন। অতএব শেষ ভরসা বাড়ির শিশুটি। সে বাধ্য হয় কোন দোকানে কাজে যোগদান করতে। স্বভাবতই শিশুশ্রমের(child labour) সরবরাহ দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।
পরিবারের সব সদস্যই বর্তমান। মা-বাবা দাদা অথবা অন্য কোন উপযুক্ত জোয়ান সদস্য। কিন্তু অভিভাবক নেই। আপনারা বলবেন বাবা-মা’তো শিশুর অভিভাবক সরকারিভাবে। কিন্তু বাস্তবে কার্যক্ষেত্রে অভিভাবকের বৈশিষ্ট্য গুলো মা-বাবার মধ্যে বা পরিবারের কোন সদস্যের মধ্যে নাও থাকতে পারে। অভিভাবক তাকেই বলব যা শিশুর অভাব-অভিযোগ, শিক্ষার দায়িত্ব, শিশুর স্বাস্থ্যের প্রতি একশো শতাংশ নজর দেওয়া, শিশুর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করা অভিভাবকের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য না থাকলে শিশুটিকে অভিভাবকহীন বলা ছাড়া কোন উপায় থাকেনা। তাইতো শিশুটি বাধ্য হয় কোন দোকানে বা গ্যারাজের শ্রমিক হিসেবে নিজেকে নিয়োগ করতে। বাড়তে থাকে শিশু শ্রমিকের(Child Labour)সংখ্যা।
যেখানে শিশু বসবাস করে অর্থাৎ যে স্থান শিশুটির বাড়ি সেখানকার পরিবেশ শিক্ষাদিক্ষার অভাব, সুসমাজহীন পরিবেশে অবস্থিত হলে শিক্ষা-স্বাস্থ্য দূরের কথা, স্বাভাবিক জীবনযাপনের ন্যূনতম পরিবেশের চিহ্নটুকু থাকে না। সমাজ একটি সুশৃংখল, উদ্দাম, অনিয়ন্ত্রিত বেসুরো সময়ের মধ্যে অতিবাহিত হয়। ছোট বেলা থেকে টাকা পয়সার প্রতি মোহ সৃষ্টি হয়। নিজে থেকেই তার কাজ খোঁজার চেষ্টা করে নিজেকে শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করে।
কিছু কিছু পরিবার, সামাজিক পরিবেশ শিক্ষার প্রতি কোনরূপ ভরসা করতে পারেনা। শিশুটিকে বিদ্যালয় ভর্তি করে যে সে পরিবারে শিশুটি মানুষ হবে বা কোন কাজ কর্মে নিযুক্ত করতে পারবে তার প্রতি ভরসা থাকে না। ফলে শিশুটি উপযুক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে শ্রমিক হিসেবে কাজ করাতে বাধ্য হয়।
অনেক পরিবারে এমন ধারণা আছে যে বেশি শিক্ষা লাভ করে শিশুটি না পাবে কোন সরকারি কাজ, না পারবে শ্রমিকের কাজ করতে। শ্রমিক হিসেবে যদি কাজ করতেই হয় তাহলে শিশু বয়স থেকেই অভ্যাস তৈরি করা ভালো। বেশি বয়সে শিশুটি লজ্জায় হোক বা একটু বেশি পড়াশোনা করার কারণেই হোক আর দোকানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করার মানসিকতা তৈরি হবে না। কাজ করতে চাইবে না।
স্বাভাবিক কারণে অভিভাবকরা ছোট বয়সে শিশুকে দোকান বা কোন গ্যারেজে গাড়ির খালাসি হিসেবে তার সন্তানকে বা কন্যা হলে কারো বাড়িতে কাজ করতে পাঠায়।
সরকারের পক্ষ থেকেও সে রকম কোনো ভরসাযোগ্য প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায় না। যাকে নির্ভর করে শিশুটিকে শ্রম থেকে বিরত করে। এছাড়া এখনো পর্যন্ত সব স্থানে উপযুক্ত বিদ্যালয় বা শিশুশ্রম বিরোধী ক্যাম্পেইন(anti child labour campaign) বা সংস্থা 100% ফলাফল দেয়নি।
নেতা মন্ত্রীদের দেখা যায় ঠিক ভোটের এক মাস কি দু মাস আগে। যে সমস্ত পরিবার বা সমাজ থেকে বেশি শিশু শ্রমিক আসে সেখানে নেতাদের ভুরিভুরি প্রতিশ্রুতির বাতাবরণে দম বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা। কিন্তু ভোট মিটলেই না থাকে সে প্রতিশ্রুতি পালন, না থাকে সরকারিভাবে কোনো প্যাকেজ। যাকে ভরসা করে দীর্ঘ সময়ব্যাপী ওই পরিবারগুলি তাদের শিশুকে শিশুশ্রম(child labour) থেকে বিরত করে।
আমাদের সমাজ এখনো জাতিভেদ প্রথা কে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। জাতিভেদ প্রথার কলঙ্ক বয়ে বেড়াচ্ছে বহু সমাজ, বহু পরিবার। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘোরামি রয়েছে, রয়েছে হীনমন্যতা। যেহেতু তারা নিচু জাত সুতরাং তারা শিক্ষা থেকে নিজেদের এমনিতেই বঞ্চিত করে রাখে। বাউরি বাগদী রুইদাস বা এরকম আরো অনেক পদবীধারী পরিবারগুলি নিজেদের অধিকার থেকে নিজেদের বঞ্চিত করে রাখে। বঞ্চিত করে রাখে সামাজিক অনুশাসন ও ভিন্নতার কারণে।
জাতিগত পেশাকে তারা বেশি প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টায় থাকে। সুখ শান্তির আশায় তাদের শিশুদের শিক্ষা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার স্বপ্ন দেখানোটাও তারা পাপ বলে মনে করে। তাইতো শিশুটির চায়ের দোকানে কাপ প্লেট ধুতে ধুতে শৈশব কেটে যায় গুমড়ে গুমড়ে।
তাছাড়া আরো অন্যান্য নানা রকম কারণ রয়েছে একটি শিশুকে শ্রমিকে পরিণত হবার। সেগুলো আলোচনা হতে হবে।
এমন কিছু কিছু কাজ রয়েছে যে কাজগুলো খুবই ছোট বা কম পরিশ্রমের। সেখানে একজন পরিনত শ্রমিকের পক্ষে খুবই হালকা কাজ। পরিণত শ্রমিক কিন্তু কম পারিশ্রমিকে এ কাজ করবে না। তাই মালিক পক্ষ থেকে ওই কাজ করানোর জন্য একজন শিশুকে পছন্দ করে। এমন অনুরোধ আরজি নিয়ে সে ও সমস্ত পরিবারের কাছে যায়। স্বভাবতই শিশু শ্রমিকে পরিণত হতে সময় লাগে না।
মোটকথা শিশু শ্রমিক বেশিরভাগ দেখা যায় গ্রামাঞ্চল এবং শহর বা আধা শহরে বিধিবহির্ভূত ইনফর্মাল ইকোনমিক্স এর ক্ষেত্রে। যেখানে কম সময়ে বা হালকা কাজের ক্ষেত্রে অথবা সে অংশ যেখানে পরিণত শ্রমিকের পক্ষে খুবই সহজ সরল। মালিকের পক্ষে তার পারিশ্রমিক বেশি বলে মনে হয়।
নিচের ক্ষেত্রগুলি নিয়ে আলোচনা করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে যেমন-
1. চায়ের দোকান | রেস্টুরেন্ট | ছোট হোটেল | Hotel and Restaurant-
গ্রাম ও শহরের চায়ের দোকান রেস্টুরেন্ট হোটেলে শিশুশ্রমিক দেখা যায়। একটা সাধারণ ব্যাপার- চায়ের কাপ প্লেট বা রেস্টুরেন্টের হালকা থালা বাসন, হোটেলের থালা-বাসন ইত্যাদি ধোবার জন্য সরল সাদাসিদে শিশুদেরকে মালিক পছন্দ করে। যদিও কাজটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ এবং যত্নসহকারে করতে হয়। একজন পরিনত শ্রমিকেলই করা উচিত, তথাপি শিশু শ্রমিককে বেশির ভাগ স্থানে দেখা যায়।
কারণ- একদিকে কম বেতনে শ্রম পাওয়া যায়। অন্যদিকে শিশুটিকে নিজের পছন্দমত শাসনে রেখে কাজ আদায় করা সহজতর হয়। যদি খাবারের প্রশ্ন আসে তাহলে শিশুকে কম খাবার দিলে সমস্যার সমাধান হয়
2. মোটর গ্যারেজ | Motor Garrage-
বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে কাদা মাটির ঢেলা কে যা তৈরি করবে তাই তৈরি হবে। কাদামাটির নরম থাকে। যে কোন আকার দেওয়া যায়। শিশুকেও কাদা মাটির সাথে তুলনা করা হয়। অভিভাবক তার শিশুকে তার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার জন্য মোটর গ্যারেজ বা কোন ওয়াকসপে কাজ শেখানোর জন্য নিয়োগ করে শিশু বয়সেই। এর ফলে দুটো দিকের সুবিধা হয়- এক) গ্যারেজ মালিক বিনা খরচায় একজন জোগাড়ে পায়। কখনো কখনো মালিক সামান্য পারিশ্রমিক এবং খাবার দিয়ে হাত গুটিয়ে নেয়। দুই) শিশুর অভিভাবক শিশুকে গ্যারেজের দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকেন তার ছেলে একজন মিস্ত্রি হবে এই ভেবে। তার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হবে।
3. ভ্যারাইটি স্টোর্স
গ্রামাঞ্চল, শহর, আধা শহরের গ্রোসারি ভ্যারাইটি স্টোর্সেও শিশুশ্রমিক দেখা অসম্ভব নয়। সাধারণত এই সমস্ত দোকানে কিছু হালকা মালপত্র ওঠানামা, কাস্টমারকে সাহায্য করার জন্য শিশু শ্রমিককে মালিক বেশি উপযুক্ত বলে মনে করেন
4. গৃহের চাকর হিসেবে কাজ করার জন্য
বিভিন্ন বাড়িতে গ্রাম শহর সমস্ত অঞ্চলে চাকর এর কাজ করার জন্য মধ্য বা উচ্চবিত্ত পরিবার গুলিতে শিশু শ্রমিক নিয়োগ অসম্ভব নয়। এখানে অবশ্য পুরুষ-মহিলা সকল লিঙ্গের শিশুদের চাকর হিসেবে দেখা যায়। রেস্টুরেন্ট কন্যা শিশু শ্রমিকের তুলনায়, পরিবারের চাকরানী অনেকে নিরাপদ বলে মনে করেন। কিন্তু আদতে সেটা একটা নিরাপদ স্থান কি’ না অথবা সেটা কতটা নিরাপদ এ নিয়ে পড়ে আলোচনায় আসা যেতে পারে।
5. সুতো ও বস্ত্র শিল্পেে
অর্গানাইজড সেক্টর এর মধ্যে শিশু শ্রমিক বস্ত্র বয়ন শিল্পের নিযুক্ত রয়েছে। ছোট কল ও বস্ত্র উৎপাদন কারখানাটি বিভিন্ন সেক্টরে তুলনায় হালকা কর্মে শিশুদের নিয়োগ করা হয়। স্বাভাবিকভাবে বলা যায় মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু ইত্যাদি রাজ্য যেখানে বস্ত্র বয়ন শিল্প কারখানা বেশি, সেখানে শিশুশ্রমিক(child labour) থাকবে।
নিয়োগের কারণ হিসেবে বলা যায়- দারিদ্রতার কারণে পরিবারের আর্থিক চাহিদা, অন্যদিকে মালিকের কম বেতনে কাজ করানোর প্রবণতা একে অপরের পরিপূরক। উভয় পক্ষের চাহিদা মেটানোর সমাধানে শিশু শ্রমিক(child labour)।
6. ইটভাটা।
গ্রাম-শহরের ইটভাটায় শিশু শ্রমিক দেখা যায়। ইনভাটার কাজ কিন্তু কম পরিশ্রমের নয়। এই কাজ পরিণত শ্রমিকদের দিয়েই করানো উচিত। কিন্তু একদিকে শিশুর পারিবারিক চাহিদা, অন্যদিকে মালিকপক্ষের সীমাহীন কম বেতনে কাজ করার প্রবণতা শিশুদের ইটভাটায় কাজ করতে বাধ্য করায়।
7. চাষের কাজ
চাষের কাজেও শিশুদের দেখা যায়। চাষের কাজের বিভিন্ন ছোট ছোট কাজ আছে যেখানে পরিণত শ্রমিকের পক্ষে হালকা। আবার একজন শিশুর পক্ষে কষ্টদায়ক হতে পারে। বড় জাতের মালিকরা শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহকারী কৃষিজাত সামগ্রী যেমন পাট, সরিষা তুলো আক ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে শিশুশ্রমিক যোগানের প্রয়োজনে শিশুদের নিযুক্তি হয়।
8. ভিক্ষাবৃত্তি
কিছু কিছু ফোড়ে বা দালাল গোছের মানুষজন আছেন তারা বাইরে থেকে শিশুদের নিয়ে কোন একটা জায়গা আবদ্ধ করে রাখে। এবং তাদেরকে দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করায়। সেই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে সামান্য কিছু অংশ তাদের দেয়। অথবা সামান্য কিছু খাবার দেয়। আর বেশিরভাগটাই সে নিজে কুক্ষিগত করে। শিশুদেরকে চরম অপমান করে, যারপরনাই প্রহার, অত্যাচার চলতে থাকে শিশুদের উপর।
কখনো কখনো শোনা যায় অপহৃত শিশুদের হাত পা ভেঙ্গে বা অন্যকোন অঙ্গহানি করে দিয়ে পঙ্গু পর্যন্ত করে দেওয়া হয়। এই ধরনের অত্যাচার ও নির্মম কাজ শাস্তির যোগ্য সমাজবিরোধী অপরাধ।
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কি করনীয় | এবিষয়ে উত্তর অনুসন্ধানে শিশুশ্রমের কারণ গুলোর দিকে নজর দেওয়া মূলত খুবই জরুরী। আমরা পূর্বের কারণগুলোর সমাধান বের করতে পারলে অনেকাংশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা কমাতে পারবো বা শিশুশ্রম রোধ করতে পারব।
মূল কারণ যদি হয় দারিদ্রতা তাহলে দারিদ্রতা দূর করার জন্য যা করনীয় তার প্রতি বিশেষ নজরদারি দেওয়া প্রয়োজন। অর্থাৎ
ক. কর্মী নিয়োগ বৃদ্ধি |
পরিবারের রোজগারের প্রতি বিশেষ নজর প্রদান। যে যেরকম যোগ্য সেই কাজকর্মের নিয়োগের নিশ্চয়তা বৃদ্ধি। শুধু মৌখিক বা খাতায়-কলমে নিশ্চয়তা নয়। কর্ম দিন সংখ্যা বৃদ্ধিও একান্ত জরুরী।
তার সাথে আছে উপযুক্ত পারিশ্রমিক। একটি পরিবারের প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক বা সেই পরিবারের রোজগারী কর্মী সংখ্যা বৃদ্ধি বিশেষ করে প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
খ. সরকারি প্রতিশ্রুতির নিশ্চয়তা |
সরকারিভাবে সেই দরিদ্র পরিবারগুলিকে নিশ্চিতভাবে কর্মে নিয়োগ করা বা কর্মসংস্থান করা একান্ত জরুরি। সরকারিভাবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলিকে কর্ম নিশ্চয়তা যজ্ঞের শামিল করা প্রয়োজন। যেকোনো সংস্থা ই হোক না কেন পারিবারিক রোজগার বৃদ্ধি পেলে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা অবশ্যই কমবে।
গ. বিদ্যালয় সংখ্যা বৃদ্ধি
দরিদ্র সমাজ দরিদ্র পরিবারগুলির সন্নিকটে বেশিসংখ্যক বিদ্যালয় গঠন করার প্রয়োজন। যেখানে শিশুরা সহজেই বাড়ির কাছে তার বিদ্যালয়ে যেতে পারে। বিদ্যালয় ৫-৬ জন ছাত্রছাত্রীকে দেখেও অন্য শিশুদের মনে এ ধারণা উদ্রেক হওয়া স্বাভাবিক যে তাদের বিদ্যালয়ে যেতে হবে। তাদের বিদ্যালয় যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে আশা করা যায়। শিশু শ্রমিকের সংখ্যা রাস হবে।
ঘ. সচেতনতা দুপক্ষের মধ্যে উদয় হওয়া প্রয়োজন।
এক- অভিভাবকদের মধ্যে– সরকারি সংস্থার মাধ্যমে, বিভিন্ন NGO, সচেতন ব্যক্তিদের বা সমাজসেবীদের মাধ্যমে শিশুর অভিভাবকদের মধ্যে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন আছে। যাতে অভিভাবকেরা ভরসা পায় যে, তার শিশুটির জীবন মূল্যবান। শিশুটিকে ভবিষ্যতে দেশের প্রয়োজন। দেশ পরিচালনার জন্য তার শিক্ষার প্রয়োজন। কাজ করার জন্য সারাজীবন আছে। কিন্তু শৈশব নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে। শিশুর শৈশবের জীবনযাপনকে রুদ্ধ করলে আদতে সেই শিশুর, সেই পরিবারের, সর্বোপরি দেশের ক্ষতি। এই বোধ জাগ্রত করার জন্য সকল স্তরের মানুষ ও সংস্থাকে এগিয়ে আসতে হবে।
দুই- মালিক পক্ষকে সচেতন করা– মালিকপক্ষের পরিবারের শিশুটিকে কি শিশু শ্রমিক হিসেবে কোনো ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়? উত্তর- না। তাহলে কোন যুক্তিতে একজন মালিক অন্য পরিবারের শিশুকে তার সংস্থায় বা তার দোকানে বা তার পরিবারের শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করে? এ কোন ধরনের মানসিকতা এক চরম মূল্যবোধহীন মানসিক প্রবৃত্তি।
মালিকপক্ষের শিশুটি যদি বিদ্যালয় যাবার অধিকার থাকে, মালিকপক্ষের শিশুটিকে যদি দেশের কাজে প্রয়োজন হয়, একজন দরিদ্র পরিবারের শিশুদের দেশের কাজে সামিল হওয়ার অধিকার আছে। এই ধরনের সচেতনতা মালিকপক্ষের সামনে উত্থাপন করা বিশেষ প্রয়োজন।
ঙ. আন্তর্জাতিক স্তর থেকে আন্তর্জাতিক শ্রম ও সংগঠন, সারা পৃথিবীর জন্য প্রায় একই ধরনের আইন প্রণয়ন করে। ভিন্ন দেশে তার পরিস্ফুটন বিভিন্নভাবে হলেও মূলত গাঠনিক নিয়ম প্রায় একই।
ভারতের শিশু শ্রম আইন অনুযায়ী
বর্তমানে ১৪ বছরের নিচে কোন শিশুকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ ও খাটানো আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। অন্যদিকে আঠারো বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত কোনো শিশুকে কোন সংস্থায় স্থায়ী কর্মী হিসেবে নিয়োগ করা যাবেনা। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকে এমন কোন কাজে নিয়োগ করা যাবে যে কাজগুলো মূলত খুবই হালকা এবং যেখানে জীবনহানি বা কোন বিপদজনক কর্ম হয় না।
শিশু শ্রম আইনের মধ্যে আর্টিকেল নাম্বার 21A-তে রয়েছে রাইট টু এডুকেশন। ২০০৯ সালে কঠোরভাবে চালু হয়। বলা হয় ১৪ বছর বয়সী সকল শিশুকে বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি হতে হবে। বিদ্যালয় যেমন ভর্তি করাবে, অন্যদিকে অভিভাবক ভর্তি করাতে বাধ্য হবে।
তাছাড়া আর্টিকেল 24- এ রয়েছে শিশুদের শ্রমিক হিসেবে নিয়োগের সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা। কোন সংস্থা বা ব্যক্তি ১৪ বছরের নিচের বয়সী শিশুকে কর্মে নিযুক্ত করতে পারবে না।
আর্টিকেল ৩৯- এ রয়েছে রাজ্য সরকার বা ওই ধরনের কোনো সরকারী বিভাগ, তাদের উপর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে সেই রাজ্যে বা সেই অঞ্চলের শিশুশ্রমের প্রতি নজরদারি করা। এবং শিশু শ্রমিক নিয়োগকারী ব্যক্তি বা সংস্থার উপর আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার।
আন্টি চাইল্ড লেবার ল(Anti Child Labour Law)এর উর্দ্ধে যা প্রয়োজন তা হলো মানসিকতা পরিবর্তন। মানসিকতার পরিবর্তন না হলে সামাজিক বোধের উত্তরণ ঘটানো খুবই মুশকিল। সে ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন করে সব পরিবর্তন সাধন অসম্ভব হয়ে পড়ে। কথায় বলে আইনের ফাঁকফোকর, সেই ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় সামাজিক অপরাধীদের মাথা থেকে শরীর। তাইতো অপরাধীরা শাস্তি পায় না। চলতে থাকে শিশুশ্রম।
অতিমারির সময় কিভাবে বাড়ল শিশুশ্রম।
অতিমারিতে স্কুল বন্ধ। অনলাইন-পাঠে বঞ্চনা থেকে শুরু করে পেটের তাগিদে নানা কাজে নামতে বাধ্য হওয়ায় শিশুশ্রম বৃদ্ধির সমস্যায় ছোটরা ভীষণ ভুগেছে বলেই জানায় সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা।
ওয়েস্ট বেঙ্গল রাইট টু এডুকেশন ফোরাম এবং ক্যাম্পেন এগেনস্ট চাইল্ড লেবার নামে দু’টি নাগরিক সংগঠন সমীক্ষা চালিয়ে দেখতে চেয়েছিল, লকডাউন পর্বে পশ্চিমবঙ্গে শিশুদের অবস্থা ঠিক কী রকম। বাংলার ১৯টি জেলায় ২১৫৪ জন খুদে পড়ুয়ার মধ্যে ওই সমীক্ষা চালিয়ে যে-তথ্য উঠে এসেছে, তাতে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে বলে জানাচ্ছেন সমীক্ষকেরা। দেখা যাচ্ছে: রাজ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইনে পঠনপাঠনের সুযোগ পেয়েছে মাত্র ২৯ শতাংশ পড়ুয়া। বাকিরা সেই সুযোগ-সুবিধা পায়নি। নানা কারণে পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় ১৭% শিশুর নিয়মিত দু’বেলা আহার জোটেনি। স্কুল বন্ধ থাকায় এবং পারিবারিক আয়ে টান পড়ায় শিশুশ্রম বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। পড়ুয়াদের মধ্যে ছেলেদের ক্ষেত্রে শিশুশ্রম বৃদ্ধির হার ৯৪.৭%। কিন্তু মেয়ে পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে ওই হার প্রায় ১১৩% বেড়েছে। অর্থাৎ লকডাউনের দরুন ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজে নামার হার বেড়েছে। সামগ্রিক বিচারে ওই হার ১০৫ %!
করোনা আবহে ব্যাহত হয়েছে শিশুদের চিকিৎসাও। এই সময় পর্বে অসুস্থ হলেও ১১ শতাংশ খুদে পড়ুয়া যথাযথ চিকিৎসা পায়নি বলে ওই সমীক্ষায় জানা গিয়েছে। সোমবার একটি ওয়েবিনারের মাধ্যমে সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্য শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী। সাধারণ ভাবে সারা বছরের নিরিখে ওই সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এ বার লকডাউন পর্বে মে ও জুনের পরিসংখ্যান নিয়ে বিশেষ সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। শিশুদের উপরে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রভাব বুঝতেই এই সমীক্ষা বলে জানায় সংশ্লিষ্ট দু’টি নাগরিক সংগঠন। তাদের সমীক্ষা জানাচ্ছে: এ রাজ্যে যত সংখ্যক পড়ুয়া অনলাইন-পাঠের সুবিধা পাচ্ছে, তা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণের বেশি। বঙ্গে ওই হার ২৯% হলেও দেশে তা মাত্র ১৪!
অনন্যাদেবীর বক্তব্য, অতিমারির সময়কার এই সমীক্ষা শিশুদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে উপযুক্ত নীতি নির্ধারণে সাহায্য করবে। সারা রাজ্যের ১৯টি জেলার যে-সব পড়ুয়াকে নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৭৩ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন। সমীক্ষকদের বক্তব্য, এই পরিসংখ্যান থেকে পরিস্থিতির আভাস মিললেও এটা পূর্ণ চিত্র নয়। ‘‘সমস্যার ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করে সামগ্রিক ভাবে সেগুলির সমাধানে যাতে তৎপর হওয়া যায়, সেই জন্যই এই উদ্যোগ,’’ বলেন রাইট টু এডুকেশন ফোরামের (পশ্চিমবঙ্গ) আহ্বায়ক
আসুন আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হই- সমস্ত শিশুরা বিদ্যালয়ের আওতায় আসুক। পড়াশোনা করুক। দেশ গড়ার কর্মে আত্মনিয়োগ এর সূচনায় বাতি জুলুক।
সুত্র - abp বাংলা
We hate spam as much as you do