Tranding

01:20 PM - 01 Dec 2025

Home / Article / জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস

জালিয়ানওয়ালাবাগ দিবস

এই আইন বলে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবী কাজকর্ম দমন করার নামে আসলে ভারতীয়দের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করতে চাইলো । গান্ধীজি তখন সত্যাগ্রহ এবং ধর্মঘটের এর মাধ্যমে প্রতিবাদের আয়োজন করেন। তখন অবস্থা এমনই যে সাদা চামড়ার ইউরোপীয় যে কোন কর্মকর্তা দেখলেই ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতো। এই কালা কানুন এর বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়।

জালিয়ানওয়ালাবাগ  দিবস

জালিয়ানওয়ালাবাগ  দিবস 

নির্মল কান্তি দাস 
 ১১জুন ২০২৩

১৭৫৭ সালে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনাধীনে আসে। উপবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ভারতের উদীয়মান ধনিক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে।এই আকাঙ্ক্ষার সংহত রূপ ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা। প্রথমদিকে রাজনৈতিক দলটির লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনাধীন থেকেই ন্যায় বিচার এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ । 'কিন্তু', ইংরেজ সরকার এই দাবিতে কর্ণপাত করেনি।  এদিকে  ওরা আমাদের দেশে কল কারখানা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার দিকে নজর দেয়। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়। এশিয়া এবং আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো দখল করে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেওয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আর তারই ফল ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ পর্যন্ত বিশ্বযুদ্ধ। স্বায়ত্তশাসনের আশায় ভারতও এই যুদ্ধে ইংরেজদের সাথে অংশ নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে দেখা গেল ওদের ঔপনিবেশিক নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি। এর থেকেই ক্ষোভ এবং ইংরেজবিরোধী মনোভাবের দ্রুত ব্যাপ্তি ঘটতে থাকে।
ওই সময় যুদ্ধে যেসব সৈন্য  অংশ নিয়েছিল তাদের বেকার করে নিজ নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধ অব্যবহিত পরে অর্থনৈতিক মন্দা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ইংরেজ সরকার সে সময় একদিকে মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন করে আমাদের দেশের জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করে,আবার 'রাওলাট আইন' করে সকল বিক্ষোভ আন্দোলন কঠোর হাতে দমন করারও উদ্যোগ নেয়। 
সমস্ত বিপ্লবী কাজকর্ম কড়া হাতে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯১৮ সালে সিডনি রাওলাটের নেতৃত্বে 'সিডিশন'( অর্থাৎ রাজদ্রোহ) কমিটি গঠন করে। ১৯১৯ সালের ১০ই মার্চ এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রাওলাট অ্যাক্ট আইন হিসেবে লাগু হয়। স্বাভাবিকভাবে এই দানবীয় আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদ আন্দোলন ব্যাপক আকার নেয়। বিশেষ করে পাঞুাবের পরিস্থিতি খুবই অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে . এর প্রধান কারণগুলি হল:-
ক) অত্যাচারের তীব্রতা বৃদ্ধি
খ) দমনমূলক রাওলাট আইনের প্রয়োগ
গ) নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার
ঘ) অমৃতসরে সামরিক শাসন জারি প্রভৃতি।
কি ছিল এই রাওলাট আইনে ?
১) এই আইন মোতাবেক ব্রিটিশ সরকার যেকোনো ভারতীয়কে কোন ট্রায়াল ছাড়াই জেলবন্দি করে রাখতে পারতো। এই আইনে অভিযুক্ত-র বিরুদ্ধে কে অভিযোগকারী তা জানার সুযোগ ছিল না। 
২) বিশ্বাসঘাতক এর ট্রায়াল-এর জন্য আলাদা আদালত  হবে। 
৩) কেসের বিচারের পরে উচ্চ আদালতে কোন আপীল করা যেত না।
৪) জুরিদের সাহায্য ছাড়াই বিচারকরা শুনানি শুনতে পারবে। 
৫) সরকার জোরপূর্বক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারবে।
৬) কারাগারে মর্জি মাফিক যেকোনো সময় কাউকে  অন্তরীন করে রাখা যাবে।


এই আইন বলে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবী কাজকর্ম দমন করার নামে আসলে ভারতীয়দের ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করতে চাইলো । গান্ধীজি তখন সত্যাগ্রহ এবং ধর্মঘটের এর মাধ্যমে প্রতিবাদের আয়োজন করেন। তখন অবস্থা এমনই যে সাদা চামড়ার ইউরোপীয় যে কোন কর্মকর্তা দেখলেই ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতো। এই কালা কানুন এর বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়।
ঐ সময় ১৯১৯ সালের ৯ এপ্রিল পাঞ্জাবের তরুণ নেতা ডঃ সৈফুদ্দিন কিচলু , ডাক্তার সত্যপাল, রামভজ দত্ত চৌধুরী, শার্দল সিংহ,কোশী প্রমুখ-কে গ্রেফতারের সংবাদ দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে। 
দিনটা ছিল ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল রবিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা। হিন্দু শিখ সম্প্রদায় ওই দিনটিতে বৈশাখী উৎসব প্রতিপালন, কুখ্যাত রাওলাট আইন বাতিল এবং নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে অমৃতসর স্বর্ণ মন্দিরের কাছে জালিয়ানওয়ালাবাগ এ প্রতিবাদ সভা হয়। হিন্দু,মুসলিম, শিখ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কমপক্ষে 10000 মানুষের জমায়েত । মিটিং সবে শুরু হয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ এর একটিমাত্র প্রবেশপথ,মাত্র ১০ ফুট চওড়া।মিটিং সবে শুরু হয়েছে  ৫০ জন সৈন্য নিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজিনাল ডায়ার কোন সতর্কবার্তা ছাড়াই নিরীহ জনজমায়েত এর উপর অতর্কিতে গুলি বর্ষণের অর্ডার দেয়। স্থানটি চারিদিকে বড় বড় বাড়িতে ঘেরা। কোন দিকে পালাবার উপায় ছিল না। ঐদিন প্রায় দুই হাজারের উপর নিহত এবং ১৫শ এর বেশি আহত হয়েছিল। রাওলাট আইন মোতাবেক সংবাদপত্রগুলির ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় সপ্তাহখানেক এই সংবাদ কোন কাগজে প্রকাশিত হলো না। এই ঘটনা আমাদের দেখাতো বটেই ,গোটা বিশ্ব শিহরিত হয়। দেশে,বিদেশে সর্বত্র তীব্র প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। 
এই গণহত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কলকাতায় মনুমেন্টের পাদদেশে এক প্রতিবাদ সভা হয়। সেখান থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ সরকারের দেওয়া 'নাইট হুড' খেতাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন । গান্ধীজিও ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া কাইজার-ই- হিন্দ উপাধি ত্যাগ করেন । দেওয়ালে লাগা বুলেটের চিহ্ন আজও ১০৪ বছর আগেকার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রক্তস্নাত জায়গাটি  লেখকের দেখে আসার সুযোগ হয়েছিল।


এর পরের ঘটনা সবার জানা, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়। পরবর্তীতে, ভারত সরকার নিহতদের স্মৃতিস্বার্থে ১৯৫১ সালে এক স্মারক স্থাপন করে। ‘জালিয়ানওয়ালা বাগ’ দিবস বা ‘অমৃতসর হত্যাকাণ্ড’এর স্মরণে ঐদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের তরফে  প্রতিবছর স্মারকস্তম্ভের এর সামনে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদিত হয়।

Your Opinion

We hate spam as much as you do