দেশভাগের যন্ত্রনা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পূর্ববাংলায় ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর আগমন ঘটেছে পশ্চিমবাংলায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক বিভাজন পশ্চিমবঙ্গের বুকে দানা বাঁধতে পারেনি। খাদ্যের লড়াই, জমির লড়াই এই বিভাজনকে প্রতিহত করেছে। ১৯৮৪ এর শিখ দাঙ্গা বা ১৯৯২ এর বাবরি মসজিদ পরবর্তী দাঙ্গার কোনো প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে পড়েনি। সেইসূত্রে পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কেন্দ্র বলে চিহ্নিত হয়েছে।
একমাত্র রুটি রুজির লড়াই পারে বিদ্বেষ বিষ মুক্ত করতে
দুধেল গাই। গত দুবছর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে খুব চালু কথা এবং তা মূলত একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক কারণে উল্লেখ করতে ব্যবহৃত। রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যে যে এই শব্দের বহুল ব্যবহার হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি এই শব্দের ব্যবহার সামাজিক মাধ্যমে বা রাজনৈতিক সভাগুলিতে আরও তীব্র ভাবে হচ্ছে, যা বর্তমান বিষাক্ত পরিস্থিতিকে ফুটিয়ে তুলছে।
দেশভাগের যন্ত্রনা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পূর্ববাংলায় ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর আগমন ঘটেছে পশ্চিমবাংলায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক বিভাজন পশ্চিমবঙ্গের বুকে দানা বাঁধতে পারেনি। খাদ্যের লড়াই, জমির লড়াই এই বিভাজনকে প্রতিহত করেছে। ১৯৮৪ এর শিখ দাঙ্গা বা ১৯৯২ এর বাবরি মসজিদ পরবর্তী দাঙ্গার কোনো প্রভাব পশ্চিমবঙ্গে পড়েনি। সেইসূত্রে পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কেন্দ্র বলে চিহ্নিত হয়েছে।
কিন্তু অবস্থা বদলাতে থাকে। ২০০৬-পরবর্তী বামবিরোধী রাজনৈতিক কার্যকলাপের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, তাতে বিভিন্ন বিভেদকামী শক্তির অংশগ্রহন ছিল প্রশ্নাতীত ভাবে সত্য এবং ২০১১ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এদের ভুমিকা কোনো ভাবে অস্বীকার করা যায় না। পালাবদলের পর বর্তমান শাসকদল তৃণমূল রাজনৈতিক স্বার্থে তথাকথিত সংখ্যালঘু তোষণের নামে মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে। এর পাল্টা হিন্দু কট্টরপন্থাও পশ্চিমবাংলার বুকে মাথা চাড়া দেয়, ২০১৪ এর জাতীয় রাজনীতিতে পালাবদল যার পালে অক্সিজেন যোগায়। পাশাপাশি ভাষিক বা জাতিগত পরিচিতিসত্ত্বাকে উগ্রতার চেহারাও প্রদান করা হচ্ছে এই সময়কালে আর সেটা দুই শাসকদলের মদতে। তৃণমূল কংগ্রেসের মদতে রাজ্যের বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে হাতিয়ার করে প্রকাশ্যে যেমন ভিন্নভাষীদের বিতাড়ন বা আক্রমণের ডাক দেওয়া হচ্ছে, তেমনি বিজেপির মদতে গোর্খা বা রাজবংশী পরিচিতিসত্ত্বাকে ব্যবহার করে রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের উত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তৃনমূলও নির্লজ্জভাবে সেই কাজের শরিক। যার নিট ফল রাজ্য জুড়ে পরিচিতিসত্ত্বা ভিত্তিক বিভাজনের উর্বর জমি নির্মাণ।
কিন্তু আমরা যদি এর প্রেক্ষাপট খুঁজতে যাই, তাহলে দেখা যাবে বর্তমান দুই শাসকদলের কর্পোরেটমুখী নীতি এবং উদগ্র রাজনৈতিক বাসনা এর জন্য দায়ী। ২০১৪ থেকে বিজেপি সরকার দেশের একচেটিয়া কর্পোরেটদের পেট ভরাতে উদগ্রভাবে তৎপর। এই লক্ষ্যে যেমন একদিকে শুরু হয়েছে বিলগ্নিকরন, তেমনি শুরু হয়েছে সরকারী ক্ষেত্রে ছাটাই এর প্রক্রিয়া। শ্রমআইন থেকে কৃষিআইন সর্বত্র বৃহদায়তন কর্পোরেটদের সুবিধা করে দিতে ব্যাপক প্রয়াস দেশপ্রেমিক সরকারের। কিন্তু তাতে সাধারণের জীবনে নেমেছে ব্যাপক সংকট। উলটোদিকে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রভাবে কর্মসংস্থান যেমন হ্রাস পেয়েছে, তেমনি সূচনা হয়েছে একাধিক সংকটের। রাজ্যে কৃষিক্ষেত্র আজ নানাদিক থেকে সংকটের মুখে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে ভাটার টান। পরিযায়ী শ্রমিকের স্রোত এই সংকটকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি দুই দলের উদগ্র রাজনৈতিক বাসনা এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে স্বৈরতন্ত্র স্থাপনের লক্ষ্যে তৃণমূল কংগ্রেস যেমন বিরোধীশূন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তৎপর, তেমনি স্বৈরতান্ত্রিক হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপনের লক্ষ্যে হিন্দুদের সংকটের দোহাই দিয়ে বিজেপি ডবল ইঞ্জিনের তত্ত্ব খাড়া করছে যেখানে কোনোরকম বিরোধিতার স্থান নেই। যার নিট ফল সামগ্রিক ব্যবস্থায় দুর্নীতির চাষ।
এই প্রেক্ষিতে মানুষের সামগ্রিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ আসা স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। কিন্তু দুই শাসকদল এই ক্ষোভকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দিতে উদ্যত সামগ্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে। যার ফলে রাজ্যে পরিচিতিসত্ত্বাভিত্তিক মেরুকরনের দাপট বাড়ছে। স্থানীয় ইস্যুকে হাতিয়ার করে দুই দলই বিদ্বেষের চাষ করতে শুরু করেছে, যা সারা রাজ্যে মেরুকরণের আবহাওয়া তৈরি করছে। ২০১৬ এর ধুলাগড় বা ২০১৮ এর আসানসোল যার জ্বলন্ত উদাহরন। পাশাপাশি আর্থসামাজিক সংকটের ইস্যুকে পরিকল্পিত ভাবে জাতিবিদ্বেষের মোড়কে আনা হচ্ছে। তাই কর্মসংস্থানের সংকটের জন্য যেমন তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের অধিকারকে একতরফা এবং অযৌক্তিক ভাবে দোষী করা হচ্ছে, তেমনি রাজ্যের আর্থিক সংকটের জন্য ভিন্নভাষার লোকদের বিতাড়নের উস্কানি সামনে আসছে। এর সবটাই হচ্ছে রাজনৈতিক মদতে সেটা বলা বাহুল্য। এই বিদ্বেষ যে কতোটা গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে তার সাম্প্রতিক উদাহরন শীতলকুচির ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে একাংশের উল্লাসে।
কিন্তু আমাদের, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মানুষকে ভালোভাবে বাঁচার জন্য এই বিদ্বেষের চাষ তথা এর উৎস বর্তমানের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতির বিরুদ্ধে তীব্রভাবে লড়তেই হবে। তুলতে হবে আর্থসামাজিক দাবিদাওয়ার বিষয়গুলিকে। না হলে ভবিষ্যতের কাছে আমরা স্রেফ অপরাধী হয়ে যাব।
বক্তব্য লেখকের নিজস্ব
We hate spam as much as you do