লাক্ষাদ্বীপের জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই মুসলিম।আরব সাগরের বুকে লাক্ষাদ্বীপের দায়িত্ব হাতে নিয়েই তিনি এমন কয়েকটি বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার বিরুদ্ধে ওই দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা এখন ক্ষোভে অশান্ত হয়ে উঠেছেন।এরপর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তারা #save lakhadweep ক্যাম্পেনও শুরু করেছেন, কেরালার সঙ্গে ভাষাগত ঘনিষ্ঠতার কারনে এখানকার বহু বুদ্ধিজীবী বিশিষ্ট মানুষ সমর্থনে মন্তব্য করছেন।
শান্ত লাক্ষাদ্বীপ অশান্ত । কেন্দ্রীয় প্রশাসকের সাম্প্রদায়িক এজেন্ডায় বিক্ষোভ
মাত্র ৬৫০০০ প্রায় মানুষের নির্লিপ্ত, শান্ত , বিপুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব তীর্থভুমী লাক্ষাদ্বীপ এখন উত্তপ্ত , অশান্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি পরিচালিত এই ছোট্ট দ্বীপভুমীর মানুষকে অকারন উত্তেজিত করলেন প্রশাসক। এমনই মনে হয়েছিল তখন করে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখলেন ৯৩ জন প্রাক্তন শীর্ষ আমলা।
এরা কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর নয়।
আমলারা লিখেছেন কি হচ্ছে এই শান্ত ভূখণ্ডে ? কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে উন্নয়নের নামে যে নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে , তা নিয়েই চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রাক্তন আমলারা। দ্বীপবাসীদের মত নিয়েই উন্নয়নের কাজ করা হোক বলে চিঠিতে আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা।
২০২০ তে করোনা পরিস্থিতিতে প্রশাসকের দায়িত্ব নেওয়া বিজেপির প্রফুল্ল খোঁড়া প্যাটেল যা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তা দ্বীপপুঞ্জের ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের পরিপন্থী বলে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন প্রাক্তন আমলারা চিঠির একটি কপি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং পরিবেশ-বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরকেও পাঠানো হয়েছে।
প্রাক্তন আমলাদের দাবি, স্থানীয়দের ন্যুনতম মতামত না নিয়েই এই খসড়া আইন পাশের চেষ্টা হচ্ছে। এই বিষয়ে লাক্ষাদ্বীপের একমাত্র সাংসদ মহম্মদ ফয়জল একই কথা বলেছেন। দ্বীপের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ হয় এমন আইন না করা উচিত। কেন্দ্রীয়
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে আবেদন করেন ঐ আমলারা । মালদ্বীপ আর লাক্ষাদ্বীপের অবস্থান ভৌগলিক গঠন এত আলাদা যে দুটোর একই রকম উন্নয়নের কথা ভাবা ঠিক নয়।
প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে তারা জানিয়েছেন
"Each of these measures smacks not of development but of alien and arbitrary policy making, in violation of established practices that respect the environment and society of Lakshadweep. Taken together, the actions and far-reaching proposals of the Administrator, without due consultation with the islanders, constitute an onslaught on the very fabric of Lakshadweep society, economy and landscape as if the islands were just a piece of real estate for tourists and tourism investors from the outside world",
৯৩ জন প্রাক্তন আমলার তালিকায় আছেন
প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন, প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও জহর সরকার, প্রাক্তন বিদেশ সচিব সুজাতা সিং, প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন উপদেষ্টা টি কে এ নায়ার-সহ আরও অনেকে।
এদেশের অঙ্গরাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে কাশ্মীর ছাড়া লাক্ষাদ্বীপে ৯৮% মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন। কিন্তু লাক্ষাদীপ ও মিনিকয় খুবই শান্ত এলাকা।
আরব সাগরের বুকে গোলাকৃতি ৩৬টি কোরাল দ্বীপ (অ্যাটল) নিয়ে গঠিত এই লাক্ষাদ্বীপ, আর কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত একজন প্রশাসকই এখানে সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্মের তদারকি করে থাকেন।
এর আগে খুব সিনিয়র আমলা বা আইপিএস অফিসাররাই এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন, তবে সেই ধারায় ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গুজরাটের একজন পুরোনো পরিচিত বিজেপি নেতাকে এই পদটি দেয়া হয়েছে।
গত ছ'মাস ধরে লাক্ষাদ্বীপে সেই প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন প্রফুল খোডা প্যাটেল, যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-র ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। তিনি অমিত শাহ জেলে যাবার পর গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন।
লাক্ষাদ্বীপের জনসংখ্যার প্রায় ৯৮ শতাংশই মুসলিম।আরব সাগরের বুকে লাক্ষাদ্বীপের দায়িত্ব হাতে নিয়েই তিনি এমন কয়েকটি বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন, যার বিরুদ্ধে ওই দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দারা এখন ক্ষোভে অশান্ত হয়ে উঠেছেন।এরপর সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তারা #save lakhadweep ক্যাম্পেনও শুরু করেছেন, কেরালার সঙ্গে ভাষাগত ঘনিষ্ঠতার কারনে এখানকার বহু বুদ্ধিজীবী বিশিষ্ট মানুষ সমর্থনে মন্তব্য করছেন।
বিশিষ্ট নেতা শারদ পাওয়ার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে লাক্ষাদ্বীপের প্রশাসককে সরিয়ে দেয়ার আর্জি জানিয়েছেন। দেশের রাষ্ট্রপতির কাছেও একই দাবি জানিয়েছেন কেরালার বিভিন্ন দলের এমপি-রা।
প্রফুল্ল খোডা প্যাটেলের যে নীতি এই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা হল এই প্রায় একমুখী হঠকারিতা ।
নতুন প্রশাসক প্রস্তাব করেছেন,
■ লাক্ষাদ্বীপে গরুর মাংস বা বিফ খাওয়া নিষিদ্ধ করতে হবে।
জনসংখ্যার ৯৮ শতাংশ যেখানে মুসলিম,
■ লাক্ষাদ্বীপে বহু দিন যাবৎ মদ্যপান নিষিদ্ধ। কিন্তু নতুন প্রশাসক চান লাক্ষাদ্বীপের বিলাসবহুল হোটেল ও রিসর্টগুলো অ্যালকোহল পানীয় পরিবেশনের অনুমতি পাক।
■ যাদের দুটির বেশি সন্তান আছে, তাদের পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়ার অধিকার থাকবে না।
■ স্কুলে মিড-ডে মিলে এখন ডিম-মাছ-মাংসর মতো আমিষ খাবার দেওয়া হলেও তার জায়গায় শুধু নিরামিষ খাবার দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
■ গত বছর লাক্ষাদ্বীপে যারা ভারতের নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের বেশ কয়েকজনকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
■ লাক্ষাদ্বীপে 'ক্রাইম রেট' বা অপরাধের ইতিহাস প্রায় শূন্যের কাছাকাছি - অথচ সেখানে এমন একটি আইন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে দ্বীপের প্রশাসক যে কাউকে এক বছর পর্যন্ত বিনা বিচারে আটকে রাখার ক্ষমতা পাবেন। সাধারণভাবে এই আইনটি ভারতে 'গুন্ডা আইন' নামেই পরিচিত।
■ উন্নয়নের নামে লাক্ষাদ্বীপ প্রশাসন ব্যক্তি মালিকানার যে কোনও জমি অধিগ্রহণ করে নিতে পারবে।
সবচেয়ে বড় সমালোচনার যোগ্য কাজ যা প্রশাসক করলেন তা হল ২০২০ তে বাইরে থেকে যেই এসেছে তাকে কোয়ারিনটাইনে থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। নতুন প্রশাসক তা তুলে দিয়ে বিপদ বাড়িয়ে দিলেন। যার বিষময় ফল হল এই, গোটা ২০২০ সালে যেখানে পুরো লাক্ষাদ্বীপে একজনও পজিটিভ কোভিড রোগী ছিল না, এখন সেখানে প্রায় ৭,০০০ অ্যাক্টিভ কেস হয়ে গেছে। গোটা দ্বীপের শান্তি একেবারে শেষ।
লাক্ষাদ্বীপের এমপি মহম্মদ ফয়সল বলেছেন, "আমাদের দ্বীপপুঞ্জের মানুষের যে আচার, সংস্কৃতি বা খাদ্যাভাস - সেখানে কেন প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে চাইছে?"
একমাত্র সাংসদ মহম্মদ ফয়সল
"লাক্ষাদ্বীপ যেখানে মদ খাওয়া পছন্দ করে না, সেখানে কেন অ্যালকোহলের অনুমতি দেয়া হচ্ছে?"
"আমাদের দ্বীপে গুন্ডা আইন আনার কোনও প্রয়োজনই নেই, অথচ তারপরও স্রেফ মানুষকে ভয় দেখাতে এই সব আইন আনা হচ্ছে!"
মনে করা হচ্ছে প্রশাসক প্রফুল খোডা প্যাটেল লাক্ষাদ্বীপের বহু কাল লালিত সংস্কৃতিকে আঘাত করেছেন বলেই তার বিরুদ্ধ জনমত এভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে।
কেরালার সুপারস্টার পৃথ্বীরাজও সংহতি জানাচ্ছেন 'সেইভ লাক্ষাদ্বীপে'
কেরালার সঙ্গে লাক্ষাদ্বীপের সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য যোগাযোগ খুব নিবিড়, লাক্ষাদ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ মালয়লাম ভাষাতেই কথা বলেন।
সেই কেরালার মেগা-তারকা ও সিনেমা অভিনেতা পৃথ্বীরাজও এই 'সেইভ লাক্ষাদ্বীপ' ক্যাম্পেইনকে সমর্থন করছেন।
কেরালার বামপন্থী এমপি ভিনয় বিশ্বমও মনে করছেন, নতুন প্রশাসক আসলে মুসলিম-প্রধান লাক্ষাদ্বীপে একটি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই কাজ করছেন।
তিনি বলেছেন , "পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছে মি. প্যাটেল বিজেপি ও আরএসএসের দালাল হিসেবে লাক্ষাদ্বীপে কাজ করতে এসেছেন। তার আনুগত্য বিজেপির প্রতি, দেশের সংবিধানের প্রতি নয়।"
We hate spam as much as you do