পরিসংখ্যান বিভাগ দ্বারা পরিচালিত জুলাই ২০২২ থেকে জুলাই ২০২৩ সময়কালীন পর্যায়ক্রমিক শ্রম বল নিরীক্ষায় একটি মারাত্মক তথ্য উঠে এসেছে। স্বনির্ভর কর্মীদের হার মারাত্মক ভাবে বেড়ে মোট কর্মী সংখ্যার বিচারে ৫৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অর্থনীতিতে কম বেশি কর্মীর সংখ্যা ৫০ কোটি। ২০১৭ - ১৮ বর্ষে এর হার ছিল ৫২ শতাংশ যার মধ্যে সিংহভাগই ক্ষুদ্র বিক্রেতা এবং ব্যক্তি সেবা প্রদানকারী। অর্থাৎ অর্থনীতিতে প্রথম তিনের তালিকায় প্রায় ঢুকে পড়া ভারতের কর্মসংস্থানের বেহাল দশা নিয়ে মোদীজি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। সেই কারণেই পিএইচডি ডিগ্রী ধারী অনিল ডোমের চাকরির জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এম এ পাশ করা হামিদ কাঁচের চুড়ি, নেল পালিশ, টিপ, নথ, পাথরের মালা, ঝুমুর, চুলের ক্লিপ ফেরি করে অথবা বিএসসিতে প্রথম স্থানাধিকারী তমাল ভোর পাঁচটায় পৌরসভার ভ্যানরিক্সা নিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাড়ি বাড়ি আবর্জনা সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে
পদ্ম - কাঁটায় রক্তাক্ত ভারত
উত্থান দাশ
২১ এপ্রিল রবিবার ২০২৪
বেকারত্ব, দারিদ্র, অপুষ্টি জনিত মৃত্যু, শিশু মৃত্যু, বেহাল অর্থনীতি, খুন, ধর্ষণ, লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িক হিংসা.... বিগত দশ বছরে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার এবং বিজেপি পরিচালিত রাজ্যগুলির সামগ্রীক পরিস্থিতি পশ্চিম ইউরোপের মধ্যযুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর পঞ্চম এবং পঞ্চদশ শতক জুড়ে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক, বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয় তৎকালীন যুগকে অন্ধকার যুগের তকমা এনে দেয়। বিজেপির সৌজন্যে বর্তমান ভারতও সেই তকমা পাওয়ার দাবি রাখে।
‘দেশদ্রোহী’, ‘চীনের দালাল’ বামেরা বলছে না। সরকারি তথ্য বলছে, ২০১৭ - ১৮ সালে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ ছিল। ২০২৪ সালে এসেও পরিস্থিতির খুব একটা হেরফের হয়নি। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো মুদ্রাস্ফীতি, বেহাল অর্থনীতি এবং মূল্যবৃদ্ধির ত্রহস্পর্শে সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি রব উঠছে। ২০২২ বর্ষে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭.৮ শতাংশ ছুঁয়েছিল যা আট বছরে সর্বোচ্চ। একাধিক সরকারি সংস্থার সমীক্ষাতেই পরিষ্কার, দেশের ৭১ শতাংশ মানুষই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রচন্ড ভাবে উদ্বিগ্ন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায়সই হৃষ্ট চিত্তে দাবি করে থাকেন ২০২৮ - এর মধ্যে অর্থনীতির নিরিখে ভারত তৃতীয় স্থান অর্জন করবে। অথচ বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের নিরিখে ভারতের অবস্থা উদ্বেগজনক। উল্লিখিত সূচকের মাপকাঠিতে ১০০ র মধ্যে ০ সবচেয়ে ভালো স্কোর। অথচ অর্থনীতিতে তৃতীয় স্থানের লক্ষ্যে ধাবিত হওয়া ভারতের স্কোর কিনা ২৮.৭! অতএব লাভের গুড় আদানি, আম্বানিরাই লেহন করছেন এবং করবেন। বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, সঞ্চয় হার, বেসরকারি লগ্নি, বিদেশী লগ্নি, রপ্তানি - সমস্ত ক্ষেত্রেই ভারত মুমূর্ষু রুগীর মতো ধুঁকছে।
বিজেপির মদতপুষ্ট সামাজিক মাধ্যম এবং বিজেপির কাছে শিরদাঁড়া বন্ধক রাখা মূল স্রোতের (মেইনস্ট্রিম) সংবাদমাধ্যম অবশ্য এই বিষয়গুলি নিয়ে বড়োই উদাসীন। ‘হলুদ’ সাংবাদিকতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ আরএসএস - এর মতবাদ বাস্তবায়নে মগ্ন। পাকিস্তান, চীন, ইসলামি মৌলবাদ, গোমাংস, রাম মন্দির, মসজিদ, সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনে তা পূর্ণ রূপ পায়।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর বছরে ২ কোটি কর্মসংস্থানের ঢক্কা নিনাদ দশ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। আগামী বছর গুলিতে ছাঁটাইয়ের হার ২ কোটি ছাপিয়ে যেতে পারে বৈকি। অর্থনীতির সূচক জিডিপির যে হারে বৃদ্ধি হওয়ার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল - বাস্তব পরিসংখ্যান তার ধারে কাছেও নেই। ৫৬ ইঞ্চি ছাতি বিশিষ্ট যুগপুরুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিগত নয় বছরে মাত্র ৫.৭ শতাংশ বৃদ্ধি উপহার দিয়েছেন যার সিংহভাগ সেই আদানি, আম্বানিদের বরাতেই জুটেছে। এশিয়ার সবচেয়ে ধনীদের তালিকায় প্রথম দশজনের দশজনই ভারত থেকে। অন্যদিকে অর্থনীতির সমস্ত নিরিখেই ভারতের থেকে আলোকবর্ষ এগিয়ে থাকা গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কোনো শিল্পপতিই সেই তালিকায় নেই। সম্পদের অসম বন্টন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। স্বাধীনতাত্তোর ভারতের ৯০ শতাংশ সম্পদ ১০ শতাংশ মানুষের যখের ধনে পরিণত হয়েছে। অথচ সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে ভারতবাষীদের নিজেদের অর্পন করার কথা বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যাদের নির্বাচিত করে সংসদে পাঠিয়ে এই দায়িত্ব সমর্পন করা হয়েছে, তারা ভারতকে মাৰ্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলের দালাল, পুঁজিবাদী, হিন্দু মৌলবাদী, অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে সুচারু ভাবে পরিণত করার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে।
পরিসংখ্যান বিভাগ দ্বারা পরিচালিত জুলাই ২০২২ থেকে জুলাই ২০২৩ সময়কালীন পর্যায়ক্রমিক শ্রম বল নিরীক্ষায় একটি মারাত্মক তথ্য উঠে এসেছে। স্বনির্ভর কর্মীদের হার মারাত্মক ভাবে বেড়ে মোট কর্মী সংখ্যার বিচারে ৫৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অর্থনীতিতে কম বেশি কর্মীর সংখ্যা ৫০ কোটি। ২০১৭ - ১৮ বর্ষে এর হার ছিল ৫২ শতাংশ যার মধ্যে সিংহভাগই ক্ষুদ্র বিক্রেতা এবং ব্যক্তি সেবা প্রদানকারী। অর্থাৎ অর্থনীতিতে প্রথম তিনের তালিকায় প্রায় ঢুকে পড়া ভারতের কর্মসংস্থানের বেহাল দশা নিয়ে মোদীজি বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। সেই কারণেই পিএইচডি ডিগ্রী ধারী অনিল ডোমের চাকরির জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে এম এ পাশ করা হামিদ কাঁচের চুড়ি, নেল পালিশ, টিপ, নথ, পাথরের মালা, ঝুমুর, চুলের ক্লিপ ফেরি করে অথবা বিএসসিতে প্রথম স্থানাধিকারী তমাল ভোর পাঁচটায় পৌরসভার ভ্যানরিক্সা নিয়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাড়ি বাড়ি আবর্জনা সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। ঝাঁ চক চকে রাজপথের অন্তরালে কত আবর্জনা জমে যাচ্ছে, তা কী আর গুজরাট গণহত্যার মহানায়ক জানেন না? না কী জেনেও না জানার ভান করছেন?
‘হ্যাঁ। যা বলছিলাম। বিদেশী কোনো সূত্র থেকে অনুদান নেওয়া চলবে না। ভারতীয় কোনো সহায়ক থাকতেই হবে। আর সেই মারফত যত ইচ্ছে, প্রাণ খুলে অনুদান করুন। চিন্তার কারণ নেই ১৯৭৬ এর বিদেশী অবদান নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে দিয়েছি আমরা, মানে বিজেপি। অনেক শুনেছেন। এবার পড়ুন। আমার কথাটি ফুরোল। নটে গাছটি মুড়োল.... তাঁর মুকুটে আরএক পালক যোগ হয়েছে - নির্বাচনী বন্ড দুর্নীতি। অর্থনীতির পরিভাষায় একে বলে ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’ বা ‘কর্পোরেট ক্রনিজম’ যা বহমান অসাম্যকে আরও ত্বরান্বিত করে। নির্বাচনী বন্ড ২০১৭ সালে সংসদে পাস করিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দল। তাঁরা জোর গলায় দাবি করেছিলেন, স্বচ্ছ ভাবে রাজজনৈতিক তহবিল গড়ে তোলার কাজে বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল ভারত। তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রী অরুণ জেটলি বিরোধীদের এক হাত নিয়ে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে কালো টাকার অনধিকার অনুপ্রবেশ যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে। তহবিলে সাদা টাকা আনার একটাই পথ। আর তা হচ্ছে বৈদ্যুতিক ব্যাঙ্কিঙ্গ প্রযুক্তি। এখানেই থেমে না থেকে নগদ অনুদানের পরিমাণ ২০,০০০ টাকা থেকে ২,০০০ টাকায় নামিয়ে আনা হয় এবং একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলের জন্যে একটি নতুন মুদ্রার প্রচলন করেন - নির্বাচনী বন্ড। নির্বাচনী বন্ড আক্ষরিক অর্থেই হচ্ছে ধারক- এর বন্ড। অর্থাৎ প্রদান কারী এই নিশ্চয়তা পাবেন যে তাঁর নাম কোনো পরিস্থিতিতেই প্রকাশিত হবে না। অতএব নিশ্চিন্তে মুক্ত হস্তে দান করুন। কোনো খারাপ পরিণতির কথা ভুলেও ভাববেন না প্ৰিয় ‘মিত্র’রা। রাজনৈতিক দলগুলি আর অনুদান প্রদানকারীদের মধ্যে হওয়া লেনদেনের ন্যূনতম আভাসটুকুও সাধারণ মানুষের গোচরে আসবে না। জটায়ু থাকলে বলতেন, ‘হাইলি সাসপিসাশ।’
নিয়মানুযায়ী টানা তিন বছর লাভের মুখ দেখলে, তবেই একটি সংস্থা তার গড় লাভের ৭.৫ শতাংশ রাজনৈতিক দলগুলিকে অনুদান প্রদান করতে পারবে। গেরুয়া শিবির থাকতে চিন্তা কী? হটাও যত্তসব ভিত্তিহীন, সারবত্তাহীন নিয়ম। হলোও তাই! ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া কোম্পানিও যত ইচ্ছে অনুদান করতে পারবে...‘ও মশাই। কানটা আমার মুখের কাছে আনুন। ফিসফিসিয়ে আরও একটা তথ্য দিই। কোম্পানি বাস্তবে না থাকলেও চলবে। মানে কোনো ব্যবসা না করেও আপনি অনুদান দিতে পারবেন।’
‘মানে! তার মানে এই কারণেই কী জনৈক ভাইপো ধরা...।’
‘সে অনেক জটিল ব্যাপার। যা বলছি শুনুন।’
‘বেশ। বলুন তবে। সময় কাটছে না। একটু জ্ঞান অর্জন করা যাক!’
ফেল কড়ি, মাখো তেল। এই হচ্ছে নির্বাচনী বন্ডের সারমর্ম। আমার দিকে নোটের বান্ডিল ছুঁড়ে মারো। ক্ষমতায় থাকাকালীন পুরস্কার স্বরূপ বরাত তুলে দেওয়া হবে। সর্বোপরি পদলেহনকারী কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ফিরেও তাকাবে না সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলির দিকে। কোম্পানির অগ্রগতি সুনিশ্চিত করতে লক্ষ্য হবে সর্বোচ্চ লাভ প্রাপ্তি, ব্যবসার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে দেওয়া এবং শেয়ারধারকদের আরও মূল্য প্রদান করা। তা করতে গেলে নির্ভরশীল হতে হবে উদ্ভাবনী শক্তি, সেরা সামগ্রী উৎপাদন এবং বুক চিতিয়ে প্রতিযোগিতামূলক, সূনিয়ন্ত্রিত বাজারে লড়ে যাওয়ার অদম্য মানসিকতার উপর। বিজেপির সৌজন্যে এই নতুন অভিনব ব্যবস্থাপনায় চুপিসারে বিজেপি ও তার যোগ্য সহায়ক তৃণমূল ইত্যাদির ডালি পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে। বাকিটা ইতিহাস। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে এইভাবেই ‘কর্পোরেট ক্রনিজম’ যুগ যুগ জিও।
দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পুঁজিপতি ও তাঁদের ম্যানেজিং কমিটিদের সৃষ্ট গোলকধাঁধায় সদ্য প্রবেশ করা নব শিল্পপতি, উদ্যোগপতিদের আশা - আকাঙ্খার অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটে। কারণ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে আরএসএস’র সন্তানদের হৃষ্টপুষ্ট করে তোলা ক্রনি পুঁজিপতিদের পুঁজির পাহাড়ের সামনে নবাগতরা বড়োই বেমানান। এমতাবস্থায় কেইন্স’র বাবাও তাঁদের অগ্রগতি সুনিশ্চিত করতে পারবে না। তাঁদের বাজার মূল্য কেড়ে নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে অনুদান প্রদানকারীগণ। ফলস্বরূপ, স্টক মার্কেটে অনুদান প্রদানকারীদের শেয়ারের মূল্য চড়চড় করে বাড়বে এবং যথারীতি সমস্ত সংবাদপত্রের শিরোনাম হবে, ‘এশিয়ার ধনীতম শিল্পপতিদের সকলেই ভারতের।’
সাম্প্রদায়িক হিংসা, ধর্মীয় মৌলবাদ, গণপিটুনি, ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতপাতের রাজনীতি ইত্যাদিকে বিজেপি বহু দিন আগেই শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। নবতম সংযোজন মা - বোনেদের উপর ধেয়ে আসা বর্বরোচিত আক্রমণ। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই নেপথ্যে থেকেছেন গেরুয়া শিবিরের হেভিওয়েট নেতা, বিধায়ক, মন্ত্রী, সাংসদ অথবা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। অতএব ক্রন্দনরত মায়েরা আজও সুবিচারের আশায় দিন গুনছেন অথবা কবরে তাঁদের অস্থি - মজ্জা শুকিয়ে বিলীন হওয়ার পথে। এই তালিকায় নবতম সংযোজন ছ’বারের বিজেপি সাংসদ ভারতের কুস্তি ফেডারাশনের সর্বোচ্চ আধিকারিক ব্রিজভূষণ সিংহ। অলিম্পিকে দেশকে পদক এনে দেওয়া সাক্ষী মালিকদের হাহাকার টলাতে পারেনি পাষাণ স্বরূপ প্রধানমন্ত্রীকে। বহাল তবিয়তে দিন গুজরান করছেন মাননীয় সাংসদ মহোদয়। ভারতের সবচেয়ে বেশি লোকসভার আসন সমৃদ্ধ (৮০) উত্তর প্রদেশের বাহুবলী ব্রিজভূষণ জি'র গুরুত্ব মোদীজির কাছে অপরিসীম। ঠিক যেভাবে মহিলাদের ইজ্জত ভূলুন্ঠিত করার পরেও, গরীব কৃষকের একরের পর একর চাষের জমি রাতারাতি কেড়ে নিয়ে মাছের ভেড়ি, মল, স্পা, শপিং কমপ্লেক্স, রিসর্ট, হ্যাচারি বানানো শেখ শাহজাহান দিনের পর দিন দিদির পুলিশের নিশ্ছিদ্র পাহারায় সমান্তরাল সরকার চালিয়ে ছিলেন। হাথরাস, উন্নাও, কাঠুয়ার আট বছরের শিশু কন্যা আসিফা বানু, অভিশপ্ত গুজরাট দাঙ্গার বিলকিস বানু আর কামদুনি, পার্কসার্কাস, হাঁসখালি, সন্দেশখালি...সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে মহিলাদের উপর শতকের পর শতক ধরে দানবীয় আক্রমণ নেমে এসেছে। ২০২৪ - এ দাঁড়িয়ে সেই ধারা, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এখনও বহমান। সৌজন্যে বিজেপি ও তাঁদের বীরপুঙ্গবগণ। তাই তো সমাজের উচ্চবিত্ত ঠাকুর পরিবারের সদস্যরা দলিত পরিবারের নাবালিকাকে ধর্ষণ করার পর, যোগীজির পুলিশ দায়িত্ব নিয়ে রাতারাতি সেই নাবালিকার দেহ পুড়িয়ে দেয় প্রমাণ লোপাটের জন্যে। মনুসংহিতায় দেশ চালানোর ক্ষেত্রে এইভাবেই তাঁরা অগ্রসর হতে চায়। বিজেপির মদতপুষ্ট হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা প্রকাশ্যে মুসলমান মহিলাদের ধর্ষণ করার শাসানি দেয়। নিরুত্তাপ প্রধানমন্ত্রী তখন মন কী বাত - এ ব্যস্ত! মোদীজির অনুপ্রেরণায় সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার হওয়া মুসলমান মহিলাদের প্রোফাইল নিলামে তুলে দেয় গেরুয়াধারী হিন্দুত্ব যুবরা। ১১ জন গেরুয়াধারীর হাতে ধর্ষিতা বিলকিস বানু স্তম্ভিত হয়ে যান যখন গুজরাট সরকার তাঁর ধর্ষকদের ভালো ব্যবহারের দোহাই দেখিয়ে বেকসুর খালাস করে দেয়। তাঁদের ফুলের স্তম্ভ, মালা, মিষ্টি দিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে ভোলেনি বিজেপি! সুপ্রিম কোর্ট মোদীজির গালে বিরাশি সিক্কার চড় না হাঁকালে আত্মহত্যাই একমাত্র রাস্তা ছিল বিলকিসের কাছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে ৩৩টি এমন কোম্পানি রয়েছে যারা ভারতীয় মুদ্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পরেও বিজেপিকে ৪৫০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। ১৭টি কোম্পানি হয় কর ছাড় পেয়েছে অথবা কর প্রদানই করেনি বিগত সাত বছরে। ৬টি কোম্পানি বিজেপির তহবিলে ৬০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়, একটি কোম্পানি তার লাভের থেকে ৯৩ গুণ বেশি অর্থ প্রদান করেছে বিজেপিকে। তিনটি কোম্পানি ২৮ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে অথচ ১ টাকাও কর দেয়নি। শিব ঠাকুরের (পড়ুন মোদীজি) আপন দেশে, নিয়ম কানুন সর্বনেশে। বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সর্বমোট ১৫ লক্ষ কোটি টাকা বিজেপি অসদুপায়ে আত্মসাৎ করেছে। সেই টাকায় বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধী দলের বিধায়কদের ভাঙিয়ে বলপূর্বক সরকার করে চাণক্য তকমা অর্জন করেছেন এবং করছেন মাননীয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এটাই যে মোদী - শাহ জুটির ‘ইউএসপি’।
২০২১ থেকে ২০২২। এই এক বছরেই মহিলাদের উপর যৌন হিংসার সংখ্যা ৪,২৮, ৩৭৮ থেকে একলাফে ৪,৪৫, ৮৫৮ - এ গিয়ে দাঁড়ায়। ২০২২ সালে, গড়ে ৮৬টি ধর্ষণ- এর মামলা রুজু হয় গোটা দেশ জুড়ে। আর জনসমক্ষে যে কত ঘটনা আসেনি, তার সংখ্যা জানলে ভিরমি খেতে হতো। কারণ ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত মহিলারা পরিবারের ভয়ে, সমাজের ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে নেন। ক্ষতবিক্ষত মানুষকে এই নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। নচেৎ নাৎসি জার্মানি অথবা ফ্যাসিস্ট ইতালির চেয়েও কঠিন দিন আসতে চলেছে। অতএব, সাধু সাবধান।
মতামত লেখকের নিজস্ব
We hate spam as much as you do